একটি চুরি যাওয়া সাইকেল
একটি চুরি যাওয়া সাইকেল
পর্ব - ২
আমাদের নিজেদের প্রদেশে থানাতে গিয়ে সব সময়েই একটা Rejection এর মনোভাব দেখি। কিন্তু এখানে সান্ত্রী বেশ মনোযোগ নিয়ে মুন্সীর ঘরে পাঠালেন। সেখানে ছিলেন ‘পারিহার’ সাহেব। তাঁকে সব বিস্তারিত বললাম। তিনি তাঁর অফিসারকে ফোন করলেন। আমাকে একটা প্রাথমিক বর্ণনা বলতে হল যেটা উনি লিখে নিলেন। তাঁর পাশে একটি কম বয়সী সুপুরুষ চাপ দাড়িওয়ালা অফিসার বসেছিলেন। আমি বললাম টেন্টের ওখানে CCTV আছে, কারণ ওটা ফ্যাক্টরি সংলগ্ন জায়গা। উনি বললেন কোনো চিন্তা নেই। CCTV থাকলে পাকড়ে নেব। পালাবে কোথায়। আর একজন (S.I.) এ সময় বাইরে মুখ ধুচ্ছিলেন। ডিউটিতে ছিলেন না। মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে। ওনারা বললেন সাইকেল চুরি। মনে হয় গ্রামেরই কেউ নিয়েছে। ইনি বললেন, বাহ! তবে তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করতে হবে। বেশ মজা হবে কাজটা করতে। কম বয়সী একটা উত্তেজনা কাজ করছিল তার কথাবার্তায়। তবে তাদের যে এই মনোভাব, এইটা আমার পুলিশ সম্পর্কে ধারণা পালটে দিল। আমরা যেভাবে ভাবতে অভ্যস্ত, তার বাইরেও একটা জগৎ আছে। আমার মনে একটা বল এল। মনে হল, সাইকেল ফিরে পাওয়াটা বড় কথা নয়। তাদের এই যে পদক্ষেপ, সেটাই আমার পাওনা। পুলিশের কাছে আসাটা সার্থক।
এরপর ডাক পড়ল ‘SHO’ (Station House Officer) এর ঘরে। উনি’ই হেড। আমরা যাকে বলি ‘OC’ বা ‘IC’. সর্দারজী স্বরূপ সিং (SHO) বসে আছেন চেয়ারে। বেশ দাপুটে লোক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে আমাকে প্রশ্ন শুরু করলেন। বাঙালী যে একসময় অনেক মহাপুরুষের জন্ম দিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি বেশ ওয়াকিবহাল। আমি লেখালেখি করি জেনে বেশ একটা সম্মানজনক দৃষ্টি নিয়ে আমার সাথে কথা শুরু করলেন। এক অফিসারকে ডেকে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে জায়গায় গিয়ে পুরো ঘটনা জেনে আসতে বললেন।
একটা গাড়িতে করে চললাম আমি, তিনি আর ড্রাইভার। প্রথমেই সেই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হল। জানা গেল সিসিটিভি দেখলেই সমস্যার সমাধান হবে। এরপর চললাম সেই কোম্পানির কারখানায়। সেখানে কর্মীরা বললেন সিসিটিভি’র ব্যাপারে হেড অফিসের প্রমোদ স্যারের সাথে কথা বলতে হবে। তিনিই এর দায়িত্বে আছেন। হেড অফিস এখান থেকে ৩ কিমি দূরে পাহাড়ের ওপরে।
Hingni ছেড়ে চললাম সেখানে। আর্মি ক্যাম্পের ভেতরে এদের হেড অফিস (নাম- AFCON)। সেখানে প্রমোদ স্যারকে খুঁজে বের করা হল। মনে হল ইনিই এখানের প্রধান। পুলিশ এসেছে দেখে সবাই বেশ সতর্ক ও তটস্থ হয়ে গেল। প্রমোদজী সবকিছু শুনে একটি ছেলেকে সঙ্গে দিলেন এবং বললেন ফ্যাক্টরিতে গিয়ে পেন ড্রাইভে সবকিছু রেকর্ড করতে। আবার আমরা সবাই মিলে চললাম ফ্যাক্টরি।
একটা সিসিটিভি রেকর্ডিং কপি করতে খুব বেশি হলে ৩০ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু তাদের সিস্টেমের গণ্ডগোলে সেটা লেগে গেল ৩ ঘণ্টা। মনিটর চালু হচ্ছে তো UPS বন্ধ হচ্ছে। তা চালু হচ্ছে তো পেন ড্রাইভে জায়গা নেই। তা ফরম্যাট করতে আবার অন্য মেশিনে খোলো। সব ঠিক আছে তো বারবার বসের ফোন আসছে। একবার যাও বা কপি করলো, ভুল করে তাঁকে আবার রি-রাইট করলো। শেষে অন্য একটি মেশিনে যেখানে দেখতে হবে রেকর্ডিং, সেখানে আবার এই সফটওয়ার লোড করা নেই। এত কিছু করার পর দেখা গেল নীট ফল শূন্য। কারণ যে সময় চুরি হয়েছে, অর্থাৎ রাত ১১টার পর থেকে সকাল ৪টের মধ্যে, সে সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ কিছু নেই। কারণ ওই সময় কারেন্ট ছিল না। জানা গেল, কাল রাতে একটা তেলের ট্যাঙ্কার হাই রোড দিয়ে যাবার সময় রাস্তা থেকে পড়ে যায় এবং সোজা গিয়ে ১১ কেভি লাইনের ওপর পড়ে। ফলে পুরো এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটা অবশ্য কাল আমি রান্না করার সময় লক্ষ্য করেছিলাম যে হঠাৎ চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। শুধু গাড়ির লাইটগুলো দেখা যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে সেগুলো সোজা টেন্টের ওপর এসে পড়ছিল। অতএব এতকিছুর পরে আমরা আবার খালি হাতে চললাম থানায়।
বড়বাবুর ঘরে ডাক পড়ল। সব শুনে তিনি আমাকে একটা FIR করতে বললেন। তবে সেক্ষেত্রে আমার ঝামেলাগুলো সম্পর্কে আমাকে ওয়াকিবহাল করলেন। যেমন, আমাকে কোর্টে গিয়ে সাইকেল ছাড়াতে হবে। চোর ধরা পড়লে এই সাইকেলটা নিয়ে আমাকে আবার আসতে হবে। একটু রসিকতা করে বললেন, তখন যদি আবার মনে করেন, চলো আরেকবার চালিয়ে চালিয়ে কাশ্মীর যাই, তাহলে হবেনা। চট করে ট্রেন ধরে আসতে হবে। এক মুহূর্তে আমি সব ভেবে নিয়ে দেখলাম, ফেরত আসাটা নিশ্চয়ই একটা ঝামেলা, তাও আবার সাইকেল নিয়ে ফেরত আসা। তবে এ সাইকেল পাবে বলে মনে হয় না। এখানে এত বড় জায়গায় সামান্য একটা সাইকেলের পেছনে এদের অত সময় নেই যে খুঁজবে। তবে সাইকেলটা ফেরত পেলে সেটা হবে বড় প্রাপ্তি। এখন পরিস্থিতিও এমন যে এরা আমার জন্য এত তাগিদ নিয়ে কাজ করছে, না বলি কি করে। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
এরপর বড়বাবু নিজেরা মিটিং করলেন কি পদক্ষেপ তারা নেবেন এবং চারজনকে নিয়ে বাইরে বের হলেন। বড়বাবু যে গাড়িটা চালান সেটা এসে দাঁড়ালো। চারজন পুলিশ উঠলেন গাড়িতে। বড়বাবু নিজে গাড়ি চালালেন। আমি বসলাম ড্রাইভারের সীটের অর্থাৎ বড়বাবুর ঠিক পেছনে। আমাকে নিয়ে মোট পাঁচজন মিলে গাড়ি চলল Hingni যেখানে চুরি কাণ্ড ঘটেছে।
যেখানে আমি রাতে টেন্ট খাটিয়ে শুয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে দেখি চারজন ছেলে বসে আছে। বড়বাবুকে দেখে যেই তারা উঠতে যাবে, বড়বাবু হাতে ফোনটা তাদের দিকে তাক করে ভিডিও করতে করতে এগিয়ে গিয়ে বললেন, কেউ এক পাও কোথাও যাবে না। প্রথমেই তাদের নাম, ধাম, বাড়ি কোথায়, কেন বসে আছে এসব রেকর্ড করতে লাগলেন। ভিডিও হচ্ছে দেখে এবং তার কারণটা জানার সুযোগ না পেয়ে তারা কেমন একটা ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিতে লাগলো। বড়বাবু বললেন যে এখানে একটা সাইকেল চুরি হয়েছে। সাধারণ চুরি একরকম। কিন্তু এটা একটা যাত্রার সাইকেল। এই সাইকেল চুরি মানে সফর শেষ। এটা এখানকার ইজ্জতের প্রশ্ন। আমি ফিরে গিয়ে একথা সকলকে বললে সেটা হবে জম্মু কাশ্মীরের অপমান। সাইকেল আমাদের ফিরে পেতেই হবে। সবাই তাঁর কোথায় ঘাড় নাড়ল। একজনকে তিনি দায়িত্ব দিলেন কোনো খবর থাকলে দেবার।
এরপর তিনি ধরলেন সেই দোকানদার বুড়োকে। তাকে নিয়ে সবকজন পুলিশ দোকানের ভেতরে চলে গেলেন। কোনো বাইরের লোককে সেখানে তারা ঢুকতে দিলেন না। অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলল। আমি আর ঢুকলাম না। আমার তো কিছু করণীয় নেই। তাই বাইরে রইলাম দাঁড়িয়ে। অতএব কি কথা হল বলতে পারব না।
এর মাঝে একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটলো। বাইরে তাদের যখন কথোপকথন চলছিল, আমি লুকিয়ে ভিডিও করছিলাম। বড়বাবু সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। উনি আমাকে ভুল বুঝলেন। ভাবলেন আমি ওনার কার্যকলাপ রেকর্ড করছি। আমাকে উনি প্রচন্ড তিরস্কার করলেন। বললেন, “আমার কাজে আপনার ভরসা নেই? আপনি নিজেই তদন্ত করছেন? তাহলে আপনিই করুন। আমরা চললাম। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে আমরা আপনার জন্য পুরো দল নিয়ে এখানে চলে এসেছি। থানা এখন ফাঁকা। আপনি কি ভাবছেন, আমাদের কোনো কাজ নেই?”
আমি মৃদু ভাষায় বলতে চাইলাম যে আমার উদ্দেশ্য ছিল আপনাদের ভালো কাজ রেকর্ড করে সকলকে দেখানো যে দেখুন, J & K পুলিশ কত সক্রিয়। কিন্তু তিনি তা মানলেন না। কথায় আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চির দড় বেশি। পাশের এক কমবয়সী পুলিশ হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিয়ে নিলেন। আমার ভিডিওগুলো মুছতে লাগলেন। আমি আর সেদিকে না তাকিয়ে আত্মসমর্থন করলাম। কোনো কথা বললাম না। শুধু ভয় পেতে লাগলাম আমার অন্য দরকারি ভিডিওগুলো না মুছে ফেলে। এতে আমার মানসম্মান একদম ধুলোয় মিশে গেল। বড়বাবুর দিকে তাকাবার মতো জোরটাও আমার চলে গেল।
তবে সে মানসম্মান অচিরেই ফিরে পেলাম। না হলে সাইকেল যাক চুলোয়ে, আমি বাড়ি চলে আসতাম। জিজ্ঞাসাবাদের পর সর্দারজী আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন। তারপর বোঝালেন যে এরকম ভিডিও করলে তদন্তের গুরুত্ব নষ্ট হয়। পুলিশের কাজে ভরসা রাখতে হবে। আমিও আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
এরপর আমরা আবার থানায় ফিরে এলাম। আসার সময় আমার সমস্ত মালপত্তর সঙ্গে নিয়ে এলাম। সেটাই আমি চাইছিলাম। বড়বাবু যদি আমাকে থানায় না নিয়ে আসেন, এখানেই থেকে যেতে বলেন তো হয়েছে আর কি। তারা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। ফিরতে ফিরতে তারা পরিকল্পনা করছিলেন পরবর্তী ধাপে কী করা যেতে পারে। একজন পুলিশ বললেন গ্রামের এক ধার থেকে সবকটা বাড়ি চেকিং শুরু হবে। কোথা থেকে শুরু হবে তাও ঠিক হল। গ্রামের ওপর প্রান্তে পুলিশ পাহারা থাকবে যাতে কেউ না পালাতে পারে। আর একজন বললেন, “না – না। চোর নির্ঘাৎ এতক্ষণে খবর পেয়ে গেছে যে পুলিশ এসেছে। সে আর বাড়িতে সাইকেল রাখবে না। কোথাও লুকিয়ে রাখবে। তারচেয়ে প্রতি বাড়ির একজন করে তুলে এনে জেলে ঢুকিয়ে দাও। কেউ না কেউ ঠিক স্বীকার করবে।“ আমি বুঝলাম এ এক ফেলুদার গোয়েন্দা কাহিনী হতে চলেছে যার একটা কারণ আমি। একদিকে রোমাঞ্চ হচ্ছে। আবার একদিকে ভয় ও করছে এই ভেবে যে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে জানে।
সকাল থেকে কিছু খাইনি। শরীরটা কেমন কেমন করছে। সর্দারজী এক কাপ চা ও চানাচুর খাওয়ালেন। এখন আমার কোনো কাজ নেই। বাকি কাজ তাদের, যতক্ষন না সাইকেল চোর ধরা পড়ে। এরপর আমি কী করব তা আমাকেই স্থির করতে হবে। ঠিক করলাম এই Ramsoo’তেই থাকবো। এছাড়া তো উপায় নেই। সাইকেল না পেলে বাড়ি ফেরা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। না হয় দুদিন পরেই ফিরবো। থানার ভেতরেই টেন্ট খাটিয়ে যদি থাকা যায় অন্য এক পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বড়বাবুর থেকে অনুমতি নিয়ে এলেন। বড়বাবু রাজি হলেন কারণ বাইরে থাকলে যদি আমার অন্য বিপদ হয় সে তো তাদেরই সামলাতে হবে। পেছনদিকে উঁচু একটা ছাদ আছে। সেখানে টেন্ট খাটালাম। পাশেই নদী বয়ে চলেছে। এ সেই নদী যার পাড়ে Hingni তে আমি রাত কাটিয়েছি।
প্রথমে ভেবেছিলাম এটা মিলিটারিদের জায়গা। কারণ ‘SSB’ এর প্রায় জনা কুড়ি জওয়ান বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরে হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা বিশ্রাম নিচ্ছে। প্রথমে ইতস্তত করছিলাম সেখানে যেতে যদি তারা বলে যে এখানে টেন্ট লাগানো যাবে না। ভেবেছিলাম এটা তাদের জায়গা। পুলিশের একজনকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন এটা পুলিশের জায়গা। ওরা বসে আছে। তিনিও আমার সাথে এলেন এবং দেখিয়ে দিলেন কোথায় টেন্ট খাটাবো।
আমার টেন্ট খাটানো দেখে তাদের ভারী উৎসাহ। নিজেরা এগিয়ে এসে সাহায্য করতে লাগলেন। তাদের অনেকেই আমার সাথে গল্প শুরু করলেন। স্বজাতি প্রীতি বলে একটা ব্যাপার আছে। রতন রায় বলে একজন এগিয়ে এসে বাংলায় বললেন তিনি কুচবিহারের লোক। আর একজন অসমের। তাদের সাথে মনের সুখে বাংলায় কথা শুরু হল। এতদিন পর মাতৃভাষা পেয়ে দুপক্ষই কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছি। বাকিদের মধ্যে দুজন উত্তরাঞ্চলের। দুজন বিহারের। সকলেই নিজের মতো করে গল্প করতে লাগলো। আমি তাদের কথার ও প্রশ্নের ধরন দেখে প্রত্যেকের সম্বন্ধে ধারণা গড়তে লাগলাম। এরমধ্যে সবচেয়ে ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন লাগল হিমাচলের মানুষটিকে। কথায় তিনি বুঝিয়ে দেন তিনি বেশ সমঝদার। আর রতনবাবু বেশ কর্তৃত্ব নিয়ে চলেন। সকলকে বেশ অর্ডার করতে পারেন। তাঁর থেকেই মুলতঃ স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারলাম।
SSB এর এই দলটা হল “QRT” অর্থাৎ কুইক রেসপন্স টিম। তাদের কোথাও ডাক পড়লেই দৌড়তে হবে। তাই সর্বদা সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। এমনি সময়েও গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটা পরে বসে আছে। একেকটার ওজন ২০ কেজি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম সবসময় এত ভারিটা পরে থাকেন কেন? অসুবিধা হয়না? ডাক পড়লে পরতে আর কতক্ষণ লাগবে। এক মিনিটও তো লাগবে না। উনি বললেন ওই এক মিনিটেই বহু মানুষের জীবন চলে যাবে।
এরপর তিনি এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বহু গল্প করলেন। বললেন, “এই যে দেখছেন পাহাড়ের কোলে বসতিগুলো, আগে এখান থেকে পাথর ছুঁড়ত। কে ছুঁড়ত তা বুঝতে পারা যেত না। ছুঁড়েই পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে যেত।“ আমি জিজ্ঞাসা করলাম সেটা কোন বয়সী ছেলে। বললেন বেশিরভাগই যুবকরা করত। এরা নিজেদের ভারতীয় বলে ভাবতো না। এদের মনের মধ্যে ঢোকানো হয়েছিল যে ভারত তাদের জোর করে দখল করে রেখেছে। যাকে বলে মগজ ধোলাই। এর জন্য বিদেশী মদত অবশ্য আছে। তারা এই মগজ ধোলাইয়ের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে। তবে ৩৭০ ধারা উঠে যাবার পরে এখানের শয়তানরা জব্দ হয়ে গেছে। আগে এরা বিনাপয়সায় রেশন পেত। কষ্ট করে রোজগার করতে হতো না। বসে বসে খেতো। অলস মাথা শয়তানের বাসা। ফলে এইসব কাজে লিপ্ত হতো। এখন না খাটলে খাওয়া জুটবে না। তবে কেন্দ্রীয় সরকার রাস্তাঘাটের যা উন্নতি করেছে, তাতে কর্মসংস্থান বাড়বে সেটা আমিও চোখে দেখেছি। আগে এখানে ভারতের পতাকা উঠত না। এখন ঘরে ঘরে তেরঙ্গা। প্রায় প্রতি গাড়িতে তেরঙ্গা। সেটা কতটা সহজাত আর কতটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সে অবশ্য জানিনা।
আর একজন সামনের পাহাড়টা দেখিয়ে বললেন, ওখানে নাকি উগ্রপন্থীরা রীতিমতো বাঙ্কার বানিয়েছিল। ভেতরে সিলিন্ডার, চাল, ডাল, ঘি, কম্বল মজুত রেখে দিত। তাঁর পরিমান এতটাই ছিল যে বেশ কয়েকমাস তাদের বাইরে বেরতে হতো না। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে অত ব্যবস্থা রয়েছে। গুহার মুখের সামনেটা এমনভাবে পাথর দিয়ে ঢেকে রাখত যে মনে হতো একটা পাহাড়ের ঢাল।
সেসব উপদ্রব ১৯৯০ থেকে ২০১২ অবধি ছিল। এখন সেসব দিন গেছে। সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কারো জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। ফলে সেনাদেরও খুব সুবিধে হয়েছে। ৩৭০ ধারা উঠে যাবার আগে নিয়ম ছিল, কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তাঁর বিচার জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যেই হবে। বাইরে নিয়ে যাওয়া চলবে না। এতে যেটা হতো, পুলিশরা লঘু ধারা দিত। ফলে অন্যায় করলেও কম শাস্তি হতো। এই করেই দিনের পর দিন চলেছে। এখন দিন বদলেছে। ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ায় এদের বিচার হয় বাইরে। ফলে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছে। এখন মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছে। সমাজের সব ক্ষেত্রেই ভালমন্দ মিশে আছে। কিন্তু কার্যকলাপ, যেটাতে সমাজের কিছু অংশের মদত ছিল, সেটা অন্তত কমেছে।
………চলবে