বিদ্যুৎ মহারাজ

বিদ্যুৎ মহারাজ

বিদ্যুৎ মহারাজের সন্ন্যাসে রূপান্তরের গল্প

 

চলার পথে পড়ে থাকা সম্পদ যা কিছু চোখে পড়ে, তা চাক্ষুষ করে আমার জীবন সার্থক হয়। কোন পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই এসব সম্পদ আমার কাছে ধরা দেয়। যেমন বনগাঁ ভারত সেবাশ্রম সংঘের বিদ্যুৎ মহারাজ। সাধারণ একটি পরিবারের সন্তান হয়ে কিভাবে তিনি ধীরে ধীরে একটি সংঘের মহারাজ হয়ে উঠলেন, তাই নিয়েই সত্য কাহিনী অবলম্বনে এই গল্প। আমার লেখা “দেশ ভাগে হারিয়েছি যাদের” বইটির দ্বিতীয় পর্বের জন্য আমাকে কোলকাতা থেকে কুচবিহার সাইকেলে ভ্রমণ করতে হয়েছিল। সে লেখার মধ্যের সামান্য কিছু অংশ এখানে হুবহু তুলে ধরা হল।

——————————————————————————————————-

২৪ পরগণার যত পূর্বদিকে যাওয়া যায় , নদী নালা খাল বিলের পরিমান বাড়ে। সীমান্ত বরাবর অনেক অংশে নদীই হচ্ছে সীমানা। এতদিন যে  যে অঞ্চলে বিচরণ করলাম সেখানে খোলা মাঠ, জলাশয় এসবের পরিমান বেশি। তবে আজ একটা শহর অঞ্চলে প্রবেশ করলাম। লোকসমাগম ও গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, রাস্তায় ট্র্যাফিক সিগনালের সংখ্যা বৃদ্ধি সে কথাই মনে করাচ্ছে। আগেই বলেছি, এখানে রাতে ভারত সেবাশ্রমে থাকার ইচ্ছে আছে। সেখানে গিয়ে আগের পরিচিত কাউকে পেলাম না। শ্বেতবস্ত্রধারী এক মহারাজ যাকে আমরা ব্রহ্মচারী বলে আখ্যা দিয়ে থাকি, সেরকম একজন দেখি বসে আছেন। পাশে এক বয়স্ক রোগা ভদ্রলোক সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবী পরে চেয়ারে বসে। তিনি বেশ ভারীক্কি ধরনের চাউনি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই ব্রহ্মচারীর কাছে গিয়ে আমার পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানিয়ে বললাম, আগে একবার আমি এখানে থেকেছি। এবারেও একটা রাত থাকতে চাই। সেবার আপনাদের সেক্রেটারী মাহারাজ স্বামী বিশ্বাত্মানন্দের চিঠি নিয়ে এসেছিলাম। এবার কিছুই নেই, আগেরবারের অভিজ্ঞতাটুকু শুধু আছে। উনি তা বিশ্বাস করবেন কেন। আমি আগেরবারের কোনো ছবিও নিয়ে যাইনি। এটা আমার একটা ভুল হয়েছিল। আমি যতটা পারছি আগের বারের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি। বললাম আমাকে এক ভদ্রমহিলা  থাকতে বলেছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, সেক্রেটারী মহারাজ পাঠিয়েছেন যখন আর কী বলার আছে, থেকে যান। এখানেই হল যত গন্ডগোল। উনি বললেন “আমাদের এই আশ্রমে আমি এত বছর আছি, কোনদিনও কোনো মহিলা এখানে থাকেননি। আপনি কী করে বলছেন একজন ভদ্রমহিলার কথা”? আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে। প্রমাণ কিছু আমি দিতে পারছি না। ওদিকে পাশে বসা সেই বয়স্ক ভদ্রলোক, যিনি আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়েছিলেন, আমাকে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। প্রশ্নের ধরনটা শুনে আমার মনে হল যেন উনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন। আমি একটু অবজ্ঞার সুরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার আপনার পরিচয়? তিনি গম্ভীর মুখে বললেন আমি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের লোক। এই শুনে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম, এই মেরেছে! ইনি নির্ঘাৎ বড় কোনো আধিকারিক হবেন। এতক্ষণ আমাকে পরিমাপ করছিলেন। এবার আমাকে চেপে ধরে আমার যাত্রা না মাটি করেন।

                শেষমেশ অন্য এক আশ্রমের এক মহারাজকে জিজ্ঞাসা করে অনুমতি নিয়ে এই মহারাজ আমাকে থাকার অনুমতি দিলেন। আমি হাঁফ ছাড়লাম। সেখানে বসেই কিছুটা সময় কাটালাম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য। বসে তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। সেই রোগা ভদ্রলোক যিনি আমার দিকে কঠিন চোখে তাকাচ্ছিলেন, তাঁর নাম “শিবেন সরকার”। আমি  থাকার অনুমতি যখন পেয়েই গেছি, তখন আমি আজ তাদের অতিথি। অতএব তিনি আমার সাথে মন খুলে গল্প শুরু করলেন। তিনি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কর্মী ছিলেন। নিরাপত্তা রক্ষী হিসাবে কাজ করতেন। মূলতঃ মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তাতেই থাকতেন। ফলে বহু ঘটনার সামনাসামনি সাক্ষী তিনি। বললেন সময় করে সব বলবেন। ব্রহ্মচারী (তাঁর নাম বিদ্যুৎ) অবশ্য বেশি কথা বলেননি। তিনি বললেন ঘরে চলে যান, এতদূর চালিয়ে এসেছেন।  

                শিবেন বাবুই আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। তিনি যে ঘরে থাকেন, সেখানেই আরো দুটো খাট আছে। বললেন যেখানে হোক শুয়ে পড়তে। তবে অন্য ঘরও আছে। আমি চাইছিলাম একটু একা থাকতে কারণ রাতে একটু লেখালেখি করতে হবে। আমার ছোট ছোট প্রচুর মালপত্তর। সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অনেকটা জায়গা জুড়ে। বললাম যদি কিছু মনে না করেন তাহলে অন্য ঘরটাতেই শোবো। তাতে আপনারও সুবিধা হবে। উনি রাজি হয়ে গেলেন। অন্য ঘরটিতে আমাকে নিয়ে এসে যাবতীয় সব কিছু দেখিয়ে দিলেন। আমি বিশ্রাম নিতে লাগলাম। তিনি আমার পাশে বসে গল্প জুড়লেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ মিটিং কিম্বা সমাবেশের তিনি সাক্ষী। কিন্তু সে সব এখানে আলোচনা করা যাবে না।

                সন্ধ্যা আরতির পরে মহারাজ আমার ঘরে এলেন। তাঁকে এখানে সবাই বিদ্যুৎ দা বলেই ডাকেন কারণ এখনো তিনি গেরুয়া বস্ত্রধারী মহারাজ হননি, যদিও মহারাজ হওয়ার সমস্ত যোগ্যতামান তিনি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর সাথে কথোপকথনে সে কাহিনী বেরিয়ে এল কেন তিনি এখনো গেরুয়া বসনধারী স্বামীজী হতে পারেননি। সন্ধ্যারতির পরে ও রাতে খাবার আগে হাতে কিছুটা সময় থাকে। সেই সময়ে তিনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। অতিথি হলেও আমার সাথে তাঁর কথা বলার তেমন সুযোগ ঘটেনি। এটাই একমাত্র সময় সেই সুযোগ মেটাবার। তাঁর পরিচয় সেবক বিদ্যুৎ। তাঁর বাড়ি বনগাঁতেই। পারিবারিক ধনসম্পদ তাদের প্রচুর। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বলতে যা বোঝায়। তাদের বাস আছে আটখানা, সবই ৭৮ রুটের। বনগাঁ থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত চলাচল করে। পারিবারিক মিস্টির দোকান আছে, আছে তেলের ব্যবসা। বাবা কাজ করতেন মিলিটারিতে। তাঁরা চার ভাই, চার বোন। তিনি সবচেয়ে ছোট, অষ্টম গর্ভের সন্তান। প্রাচুর্যের তাদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর মন ছিল উদাসী। জাগতিক আকর্ষণ মুক্ত তাঁর মন সব সময় চেয়েছে পরম শান্তির খোঁজে পা বাড়ানো কোনো জীবন, যেখানে অন্যের জন্য নিজেকে বলি প্রদত্ত করে জীবন অতিবাহিত করা যায়। এমন একটা জীবন তিনি কাটাতে চাইতেন যেখানে কোনো সাংসারিক বাঁধন নেই। তিনি ছিলেন টাকার ওপরে শুয়ে থাকা ছেলে। কিন্তু এই টাকার বাইরেও তো একটা জগৎ আছে। সেখানের দুঃখ দুর্দশা জানতে না পারলে জগতের সবটুকু তো জানা যাবে না। যেটা পেয়েছি তার বাইরে গিয়ে যেটা পাইনি তার সন্ধানে ছুটে চলাই তো জীবন। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন তিনি যেতেন শিয়ালদহ হতে স্টুডেন্ট হেলথ হোমে। সেখান থেকে ওই প্যান্ট পরা ছোট বিদ্যুৎ চলে যেতেন বেলুড় মঠে। তারপর সন্ধ্যা নাগাত বাড়ি ফিরে আসতেন। বাড়ির কেউ এত কিছু জানত না।

                যখন আরো বড় হলেন, কলেজে পড়ার সময় মনের সুপ্ত বাসনা আরো প্রস্ফুটিত হতে লাগল। তিনি ঠিক করলেন, বাইরের জগৎ দেখবেন ভেবেছেন যখন, জগতের সব কিছুই দেখবেন। তিনি বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের সাথে সাথে মসজিদে গমন করলেন। বিভিন্ন গীর্জায় গীর্জায় গমন করলেন। তাদের কর্মকাণ্ড, আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা গ্রহন করতে লাগলেন। মনের মধ্যে একটা সমধর্ম সমন্বয়ের বীজ যেন বপন হল। কিন্তু তাও তাঁর মনের ক্ষিদে কমছিল না। কোথা থেকে তিনি নাম শুনেছিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের। কিন্তু ঠিকানা ছিল অজানা। আগেই বলেছি, তাঁদের মিস্টির দোকান ছিল বনগাঁতে। বাবা সেখানে বসতেন। একদিন দুপুরে বাবা বিদ্যুৎকে বললেন, একটু বোস, আমি খেয়ে আসছি। বিদ্যুৎ দোকানে বসে আছে। রাস্তার ধারে সেই দোকানের পাশেই ছিল একটি টায়ারের দোকান। একদিন তিনি দেখলেন, একটি গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়ালো। গাড়ির চাকায় লিক হয়েছে। এক বয়স্ক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন। পাশে তাঁর বয়স্কা স্ত্রী। এই রোদ্দুরে দাঁড়াতে দেখে তিনি নিজের দোকান থেকে দুটি চেয়ার এনে বসতে দিলেন। দরদী মনে দুটি তালপাতার পাখা তাঁদের বাড়িয়ে দিলেন। গরমে তাঁরা হাওয়া খেতে লাগলেন। এই সামান্য সৌজন্যতা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

                পরিচয় হবার পর বিদ্যুৎ জানতে পারল, তাঁরা দুজনেই ডাক্তার। ভদ্রলোক হার্টের ডাক্তার। তাঁর স্ত্রী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তাঁরা নিঃসন্তান। বিদ্যুতের মধ্যে তাঁরা যেন একটা সন্তানের ছোঁয়া পেলেন। মাতৃ ও পিতৃস্নেহে তাঁরা তার সাথে গল্প করতে লাগলেন। কথায় কথায় বিদ্যুৎ বলল, সে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের নাম শুনেছে। সেখানে যাবার খুব ইচ্ছা। “আপনারা তো কলকাতাতেই থাকেন। আপনি জানেন সেটি কোথায়”? তাঁরা বললেন, “দেখ দেখি কান্ড! আমরা নিজেরাই তো সেখানকার দীক্ষিত, অচেনা হবে কেন? আমাদের বাড়ি বৌবাজারে। আর ওটা বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে”। বিদ্যুতের তো খুব মজা। সে বলল একদিন যাবে।

                সেই মতো কয়েকদিন পর বিদ্যুৎ বাড়িতে বলল ডাক্তার দেখাতে যাবে কলকাতায়, ফিরতে দেরি হবে। ভোরবেলা চলল বনগাঁ স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য। প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখে বাবা মর্নিং ওয়াক করছেন। বাবা তো এসব জানেন না। ফলে ধরা পড়লে মুশকিল। বাবাকে লুকিয়ে টুক করে একেবারে পেছনের কামরায় উঠে বসল সে। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে শিয়ালদহ। সেই ডাক্তার দম্পতি সেখানে হাজির। সবাই মিলে চললেন বৌবাজারে ডাক্তারে বাড়ি।

                সেখানে গিয়ে শুরু হল বিদ্যুতের যত্নআত্তি । সব কিছুই চলছে ঠিকঠাক। কিন্তু যে জন্য বিদ্যতের এখানে আসা, সেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে যাবার কথা এলেই তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন বিষয়টা। বলছেন সে পরে দেখা যাবে। বিদ্যুতের কেমন যেন সন্দেহ হল। সে জিজ্ঞাসা করল ব্যাপারটা কী। তখন তাঁরা খোলসা করে বললেন যে বিদ্যুৎকে তাঁরা ছাড়তে চান না। তাঁদের সন্তান করে সারাজীবন রাখতে চান কাছে। এ ধন দৌলত সম্পত্তি কাকেই বা তাঁরা দিয়ে যাবেন। সব বিদ্যুৎ পাবে উত্তরাধিকার সূত্রে।

                কিন্তু এক ধন দৌলতের জগৎ ছেড়ে আর এক ধন দৌলতের জগতে আসার জন্য তো বিদ্যুৎ বাড়ি থেকে আসেনি। সে তো পরম ঐশ্বর্যের খোঁজে পাড়ি দিয়েছে। সে ডাক্তারবাবুকে বলল, এমন তো কথা ছিলনা। আমি যে জন্য এসেছি, আমাকে সেখানেই নিয়ে চলুন। কিছুতেই এখানে থাকব না। তখন মা (অর্থাৎ ডাক্তারের স্ত্রী) প্রচন্ড কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। কিন্তু বিদ্যুৎ গোঁ ধরে বসে রইল।

                বিদ্যুৎ মহারাজ আমাকে একমনে গল্প বলে চলেছেন। আমিও মন দিয়ে সব শুনছি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম “ডাক্তারের স্ত্রী অত করে যে কাঁদলেন, আপনাকে নিজের সন্তানের স্নেহ দিতে চাইলেন, আপনার মন নরম হয়ে যায়নি”? উনি বললেন “না। আমি মন শক্ত করেই তো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। লক্ষ্যে আমি অবিচল। কোনো ঘটনাই যেন আমাকে বিচলিত করতে না পারে”।

                আবার ছোট বয়সের বিদ্যতের গল্পে ফিরে যাই। ডাক্তার দম্পতি বিদ্যুতের জেদের কাছে হার মেনে তাঁকে নিয়ে সাড়ে বারোটা নাগাদ চললেন বালিগঞ্জে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। সেখানে ডাক্তারবাবুকে সবাই চেনে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও গেছেন। স্বপন মহারাজের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কেন এসেছো। তখন বিদ্যুৎ একটি মিথ্যা কথা বলেছিল। সে বলেছিল সে অনাথ। বাবা মা কেউ নেই। সে এসেছে সাধু হতে। আরো নানান কথার পরে মহারাজ বললেন, “কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি তোমাকে পুরী নিয়ে যাব। তুমি এপ্রিল মাসে আমার সাথে দেখা কর।  

                দিনটা এখনো মনে আছে। এপ্রিল মাসের একুশ তারিখে (সম্ভবত ২০০১ সাল) বিদ্যুৎ বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে পাঁচটা দুই এর ট্রেন ধরে বনগাঁ থেকে শিয়ালদহতে নেমে সকাল সাতটায় বালিগঞ্জে সোজা স্বপন মহারাজের ঘরে। সঙ্গে কিচ্ছু নেয়নি। জামাকাপড়, টাকাপয়সা কিচ্ছু না। এমনকি ট্রেনের টিকিট পর্যন্ত কাটেনি। তিনি আবার তাকে নিয়ে চললেন দিলীপ মহারাজের কাছে। দিলীপ মহারাজ তখন সেক্রেটারী। আজকের দিনেও তিনিই সেক্রেটারী। দিলীপ মহারাজের রাশনাম হল স্বামী বিশ্বাত্মানন্দজী, যাঁর সাথে আমার আগে একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর চিঠি নিয়ে আমি সাইকেল ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। স্বপন মহারাজ দিলীপ মহারাজকে বললেন, এই ছেলেটি সাধু হতে এসেছে। একে আমি পুরী নিয়ে যাচ্ছি। তিনি সম্মত হলেন। তার নাম ধাম লিখে তাকে একটি বই দিলেন, “জীবন সাধনার পথে”। ছোট ছোট শিক্ষামূলক অনুচ্ছেদ সম্বলিত সেই বইটি পড়তে বললেন। তারপর বললেন ট্রামডিপোর সামনে জলসত্র হচ্ছে, সেখানে জল সেবা করতে।

                দুপুর রোদ্দুরে পথচারীদের জন্য বড়বড় মাটির জালায় জল রাখা থাকত। সঙ্গে থাকত বড় বড় গুড়ের বাতাসা। পথচলতি মানুষের সেবায় দান করা হত। সেখানে বিদ্যুতের ডিউটি পড়ল। প্রথমদিনেই কাজ পেয়ে সে মহা খুশি। কিন্তু দুপুরে তার পেট খিদেতে চুঁই চুঁই করছে। তাকে কেউ খেতে ডাকল না। বিকেল সাড়ে চারটার সময় একজন এসে বলল তোমায় মহারাজ ডাকছে। দিলীপ মহারাজের কাছে যেতে তিনি বললেন “তোমার খিদে পায় নি ? এত বেলা হয়ে গেছে”। বিদ্যুৎ চুপ। মুখে কোন কথা নেই। তিনি বললেন খিদে নিশ্চয়ই পেয়েছে। হাতে কিছু ফল দিয়ে এক স্বামীকে বললেন একে ওপরে নিয়ে গিয়ে কিছু খাইয়ে দাও।

                যে কোনো কাজে নামতে গেলে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। আজকের ওই দেরি করে ডাকাটাও একটা পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হল। হুজুগের মাথায় আমরা অনেক সময় সাময়িকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভালো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু প্রতি কাজের একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সেই কাজে নিজেকে উৎসর্গ করা ছাড়া দায়বদ্ধতা আসতে পারে না। সেই উৎসর্গের পরীক্ষাই হয়ত আজ বিদ্যুৎকে দিতে হল।

এরপর স্বপন মহারাজ এসে বললেন তৈরি থাকতে। আজ রাত ১২-৩৮’এ ট্রেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। ওই সময় ওড়িষ্যার পারাদ্বীপের ওপর দিয়ে সুপার সাইক্লোন ধেয়ে গেছিল। যাইহোক, কোন রকমে সে রাতে ত্রানের মালপত্তর নিয়ে ট্যাক্সি করে তারা গেল স্টেশনে। এরপর ট্রেনে করে পরেরদিন দুপুর একটায় ভুবনেশ্বর। সন্ধ্যা সাতটায় পুরী আশ্রম। পুরীর আশ্রমের প্রধান তখন ছিলেন “স্বামী মাধবানন্দ” যিনি বর্তমানে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট। স্বপন মহারাজ এবং বিদ্যুৎ পুরীতে কৃপানন্দ মহারাজের কাছে গেলেন। কৃপানন্দ মহারাজ খুবই ভালো লোক। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। সেদিন কৃপানন্দ মহারাজ বিদ্যুৎকে তিনতলার একটি ঘরে জায়গা করে দিলেন। সারাদিনের ক্লান্তি তাকে গ্রাস করেছে। ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি সে শুয়ে পড়তে চাইল। আলো নিভিয়ে শোবার পর সারারাত ঘড় ঘড় শব্দে সারারাত ঘুম হলনা। যেন ব্রীজ দিয়ে রেলগাড়ি ছুটছে। কিশোর বিদ্যুতের বহির্জগৎ সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা গড়ে ওঠেনি। মনে কৌতুহল হল সারারাত এত ট্রেন কোথায় যাচ্ছে! সকালে ঘুম ভেঙ্গে জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। ওটা ছিল সমুদ্রের গর্জন।

                পরেরদিন সকালে মস্তকমুন্ডন করে বিদ্যুতকে সাদা পোষাক পরানো হল। গুরুমন্দিরে তাকে প্রনাম করানো হল। এদিকে বাড়িতে কিছু না বলে আসার জন্য বনগাঁয় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সবাই তাকে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রামকৃষ্ণ মিশনে সে যাতায়াত করত বলে সবাই সেখানে তার খোঁজ করেছে। টিভিতে কাগজে সব জায়গায় তার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে। কিন্তু কেউ তার সন্ধান পায়নি। আসলে কেউ তো তাকে সেভাবে দেখেনি। কলকাতায় এসে সেদিনেই পুরী। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘেরও কেউ তাকে সেভাবে চেনে না। ভোর সাড়ে তিনটের সময় মন্দিরে ঠাকুর জাগানোর কাজ করত। ফুল, মালা দিয়ে ঠাকুর সাজানো। তারপর কৃপানন্দজী পুজো করতে আসতেন, তাঁকে সাহায্য করা। এরপর ত্রানের কাজে বেরিয়ে যাওয়া। ফলে কারো সাথে তার তেমন সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না।

                মস্তকমুন্ডনের পর বিদ্যুৎ সকলের কাছে বিদ্যুৎ মহারাজ বলে অভিহিত হলেন। প্রথম দিনের তিনতলার সেই সমুদ্রের গর্জনের পর দ্বিতীয় দিন তার স্থান হল মন্দিরের পাশের একটি ঘরে। কৃপা মহারাজ পুজো করতে আসার আগেই মন্দিরের সব কাজ তিনি পরিপাটি করে রাখতেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন কৃপানন্দজীর অতি প্রিয় পাত্র এবং সাথে সাথে বাকিদের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন হিংসার পাত্র। মাত্র কয়েকদিন এসেই তিনি স্বামীজীর এত কাছের হয়ে উঠলেন অথচ এতদিন ধরে যারা সাধু হবার জন্য এসে কর্ম করেছেন তারা কাছের হয়ে উঠতে পারলেন না, এটাই ছিল হিংসার কারণ। গোবরডাঙ্গার মৌসম ছিল তাদের একজন।

                এভাবে প্রায় এক-দেড় বছর অতিক্রান্ত হল। বিদ্যুৎ মহারাজের মেজদা এবং তাদের বাসের ড্রাইভার খোঁজ করতে করতে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কলকাতার অফিসে হাজির। কেউ যেহেতু চেনেনা, তাই তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে চলে যাবার আগে গেটের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সেই সময় স্বামী মাধবানন্দজী ঢুকছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কী ব্যাপার, এখানে বসে আছেন। তারা তখন তাঁদের ভাইয়ের নিখোঁজ হবার কথা বলে জানতে চাইলেন কিছু জানা আছে কি না। মাধবানন্দজী তখন বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা ছেলে এসেছিল বটে। সে তো পুরীতে গেছে। তবে সে আপনাদের ভাই কিনা জানি না”। মেজদা তখন পুরী আশ্রমের ফোন নম্বর চেয়ে পুরীতে ফোন করে জানলেন সেখানে বিদ্যুৎ নামের একটি ছেলে গেছে সাধু হতে।

                এদিকে সে খবর বিদ্যুৎ মহারাজের কানে যেতে সময় লাগেনি। সেদিন সন্ধ্যাবেলা কৃপানন্দজী বিদ্যুৎ মহারাজ কে বললেন যে তাঁর বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। তাঁর সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছিল। বিদ্যুৎ মহারাজের কপালে এল চিন্তার ভাঁজ। এতদিন পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি একটা পবিত্র জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পরিবারের পিছুটান আবার তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট না করে দেয়। এ এক সমুদ্র সমান বিপদ।

পরের দিন তিনি ত্রান কাজে বের হতে যাবেন, এমন সময় কলকাতা থেকে দুটো টাটা সুমো নিয়ে লোকজন সমেত বাড়ির লোক পুরী আশ্রমে হাজির। সঙ্গে কলকাতার পুলিশ। পুলিশ দেখে স্বাভাবিকভাবেই সবাই বিচলিত। স্বামীজী বললেন, “বিদ্যুৎ তুমি চলে যাও”। বিদ্যুৎ মহারাজ বললেন, “স্বামীজী আপনি আমাকে তাড়িয়ে দেবেন”? মহারাজ বুঝিয়ে বললেন, এভাবে হয় না। আমরা কাউকে এভাবে আটকে রাখতে পারিনা, জটিলতা বাড়বে। তুমি বরং ফিরে যাও। বিদ্যুৎ মহারাজও বিষয়টা বুঝলেন যে বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বুঝে বললেন, “স্বামীজী আপনি তাহলে একটা উপকার করুন। আমি যদি ফিরে আসতে পারি, বনগাঁর কাছাকাছি কোনো আশ্রমে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিন”। স্বামীজী তখন বাগদার কাছে গোবরপুরের আশ্রমের জন্য একটি চিঠি লিখে দিলেন। তখনো বনগাঁর আশ্রম তৈরি হয়নি।

                এভাবে বিদ্যুৎ মহারাজ আবার বিদ্যুৎ’এ পরিণত হলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বাড়ির লোক আপনাকে কেউ বকেনি”? তিনি বললেন, “না। কেউ কিছু বলেনি। আলাদা ঘর দিয়েছিল। সবাই বোঝাতো এভাবে পালিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। আমিও ঘাড় নাড়তাম। হ্যাঁ ঠিক আছে বলতাম। বাবা বেঁচে ছিলেন তারপরেও তেরো বছর। বাবা যাবার পরেই  সংসারের নির্মম নিষ্ঠুর চেহারাটা প্রকট হয়ে উঠল। সবাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল এ সংসারে কেউ কারো নয়। সবাই যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অথচ এই সত্যটা আমি ছোটবেলাতেই বুঝেছিলাম। তাই একটু শান্তির জন্য বাড়ি ছেড়েছিলাম। তারা আমাকে সুখের রাজত্বেও থাকতে দিলনা। টেনে এনে আবার আমাকে এই জাঁতাকলে ফেলল। আজকের দিনে বাবার মৃত্যুর পরে জীবন অসহনীয় হয়ে উঠল”।

                নিজের ভাগের সবটুকু ছেড়ে দিয়ে, একটা কানাকড়িও না নিয়ে আবার তিনি গৃহত্যাগ করলেন। তাঁর ভাগের একটা দোকান চালায় মেজো বোনের ছেলে। ভাইপো মাঝে মাঝে এসে দেখা করে। কিন্তু বর্তমানে তাঁর পৃথিবী অনেক বড়। তিনি এখন বনগাঁ আশ্রমের প্রধান। পরিবারের সাথে তিনি এখন আর যোগাযোগ রাখেন না। এভাবে  বিদ্যুৎ আবার বিদ্যুৎ ব্রহ্মচারীতে পরিণত হলেন। মহারাজ হবার পূর্ণ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মাঝের এতগুলো বছর গৃহে প্রত্যাবর্তনের কারণে আজ তিনি ব্রম্ভচারী। গেরুয়া বসনধারী মহারাজ হতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। সবাই এখানে তাঁকে বিদ্যুৎদা বললেও আমার চোখে তিনি বিদ্যুৎ মহারাজ। আমি তাঁকে মহারাজ বলেই ডাকি।

                চোখের সামনে এরকম একটা মহান প্রাণকে দেখতে পেয়ে তাঁর কথা উল্লেখ না করে পারলাম না। আমার পুস্তিকার যে মূল বিষয়বস্তু তার সাথে এনার কথা না আসারই কথা। কিন্তু চলার পথে আমার জীবনে এরকম বহু মানুষের সন্ধান মেলে যাদের দেখে আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হয়। জীবন বোধ বৃদ্ধি পায়। না চাইতেই তাঁরা আমার চোখে ধরা পড়েন। তাদের কথা না লিখে আমার কোনো উপায় নেই।      

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *