কনক ও BRO
BRO কথাটির পুরো অর্থ হল Border Roads Organisation। এই নামটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৪ সালে যখন প্রথম চাকরী নিয়ে নেপালে যাই। নেপালের বিরাটনগরে দেখলাম ভারতের তৈরী রাস্তা উত্তরদিকে চলে গেছে যা তৈরী করে দিয়েছে BRO। তখন পঃ বঙ্গ তথা ভারতের রাস্তা ঘাট সম্পর্কে আমাদের যা ধ্যান ধারণা ছিল তা মোটে ভালো নয়। সেখানে বিরাটনগরের সেই পিচের রাস্তা আমার মনে BRO সম্পর্কে একটা আকর্ষণ তৈরী করে। পাঁই পাঁই করে ছোটা গাড়িগুলো বহুদূর থেকে দেখতে পেয়ে রাস্তা পারাপার হতাম না। নিমেশে তারা কাছে চলে আসত। মনে হতো, এমন একটি সংস্থায় যদি চাকরী করতাম। কিন্তু জানতাম না যে সেই সমেয়ই আমার কলেজের বন্ধু কনক এই চাকরীতে জয়েন করেছে। সেটা জানতে পারলাম প্রায় ২৮ বছর বাদে এই ২০২২ সালে। এটি আদপে প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি শাখা যারা সীমান্ত অঞ্চলে রাস্তা ও অন্যান্য পরিকাঠামোর দেখাশোনা করে।
বন্ধু কনকের জয়গান করতে আমি কলম ধরিনি। গর্বের ভারতের গর্বের BRO এর যে কর্মকাণ্ড নিজে চোখে দেখলাম, তার জয়গান করতে গিয়ে কনকের কথা আসবেই, কারণ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওর মাধ্যমেই BRO কে এত কাছ থেকে দেখতে পাওয়া। সাইকেলে লাদাখ সফরে যাচ্ছি এবং যে কদিন লেহ্’তে থাকবো, কনকের কাছে থাকবো এটুকুই ঠিক ছিল। লেহ্ থেকে সাইকেলে এদিক ওদিক সফরে যাবার সময় সমস্ত মালপত্তর সঙ্গে নেবার দরকার নেই, শুধুমাত্র দরকারী জিনিষগুলো নেবো। তাহলে লাগেজ অনেক কম বইতে হবে। এর বেশি কিছুই ভাবিনি। ভাবার দরকারও পড়েনি কারণ থাকবো তো মাত্র কয়েকটা রাত। শ্রীনগর থেকে কার্গিলে আসার পরে আমি আর লেহ্’র দিকে যাইনি। আমার সফর সূচী ছিল জাঁসকারের দিকে। সেখানে প্রবেশ করার পরই আমার ফোনের টাওয়ার উধাও হয়ে গেল। প্রায় ১০ দিনের জন্য আমি জগতের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মনে আছে, মাঝে একটি দিন মায়ের সাথে কথা বলব বলে অন্যের নেট ধার করেছিলাম। Whats App এ সে দিন দেখেছিলাম বন্ধুদের লম্বা কথোপকথন যার বিষয় ছিলাম আমি। কনক আমার জন্য অধীর চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। ব্যাকুল্ভাবে বাকীদের থেকে আমার অবস্থান জানতে চাইছিল। বাকী বন্ধুদেরও সমপরিমান ব্যাকুলতা আমাকে স্পর্শ করেছিল। শুধু কয়েকটি কথায় বুঝিয়েছিলাম আমার অবস্থান ও পরিস্থিতি। কিন্তু সেই প্রথমবার কনকের একটা অন্য ছবি আমার মনে ভেসে উঠল। এতদিন ভাবছিলাম কনকের আবাসের পরিবেশ পরিস্থিতি কী রকম জানি না। তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হতে চলেছে প্রায় ২৮ বছর বাদে। Reception টা কী রকম হবে কে জানে, ফরম্যাল নাকি আন্তরিক। কিন্তু কনকের এই উদ্বেগ আমার আশঙ্কা কমালো। বুঝতে পারলাম সে আমাকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত।
এরপর সুযোগ পেলেই আমার প্রথম কাজ হতো কনককে ফোন করে বলা যে আমি ঠিক আছি, চিন্তা করিস না। জাঁসকার থেকে যতদিন না কার্গিল- লেহ্ সড়কে উঠতে পাচ্ছি জানতাম যোগাযোগ সহজ নয়। লামায়ুরুতে যেই না সেই সড়কে পা রেখেছি মোটামুটি দিনে একবার না একবার ফোনে টাওয়ার পেয়েছি। কনক শুধু একটা কথাই বলেছিল “মারাত্মক অসুবিধায় পড়লে যে কোনো নীল রঙের গাড়ি দাঁড় করাবি। ওটা আমাদের ডিপার্টমেন্টের গাড়ি। ড্রাইভার কে অন্তত ফোনটা ধরিয়ে আমার সাথে কথা বলিয়ে দিবি”। মনে মনে বলেছিলাম, তুই যে বলছিস এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভরসা। আমার যা মনের জোর তাতে মনে হয় না তোর গাড়ির সাহায্য নেবো। তবে তোর কথায় মনের জোর শতগুন বেড়ে গেলো।
এইভাবে চলতে চলতে আরো দুদিন পরে লেহ্ এর কাছাকাছি এলাম। ঘরের কাছে এলে যেন ক্লান্তি বেড়ে যায়। মনে হতে লাগল আর পাচ্ছি না। কখন কনকের কাছে পৌঁছব। একটা গোটা দিন ঘুমবো। তারপর আবার বের হব। ‘Nimoo’ তে এসে কনক কে ফোন করলাম। ও বলল আর উঁচু পাহাড় নেই, এবার সমতল। আসতে লাগবে দু ঘন্টা মতো। কী সব হিসেব টিসেব করে বলল, “১২-৩০ র মধ্যে পৌঁছে যাবি। দুপুরের খাবার রেডি রাখছি, এসে খাবি”। আমি পৌঁছলাম বিকেল ৪টের পর। সারা রাস্তাটাই তাকে গালাগাল দিতে দিতে গেলাম কারণ পুরো রাস্তাটাই উঁচু। বহুক্ষণ হাঁটতে হল সাইকেল নিয়ে। পাথর পাত্থর সাহিবের পর থেকে সমতল ও নিচু রাস্তা পেলাম। মনে মনে ভাবছি এই যার কান্ডজ্ঞান তার কাছে কতটা আশা নিয়ে যাওয়া উচিৎ বুঝতে পারছি না।
স্পিটুকে BRO অফিসের গেটে মি. সরকারের গেস্ট বলতেই ছেড়ে দিল। খুঁজে খুঁজে ওর অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি ফোন করব, ততক্ষণে সে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি আমার ঘেমো নোংরা জামাকাপড়ে আলতো করে আলিঙ্গন করলাম। তাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় তাকিয়ে দেখি কনকের পেছন দিকে তার অফিসের স্টাফেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছে। কনককে ব্যাপারটা ধরিয়ে দিতে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাদের বলল, “আমার ছোট বেলাকার বন্ধু। সেই শ্রীনগর থেকে সাইকেল চালিয়ে আমার কাছে এসেছে”। আমাকে বলল চল আমার অফিসে। কানের কাছে এসে বলল “আমার এই আবেগ এরা আগে দেখেনি। তোকে ঘর থেকে এসে জড়িয়ে ধরাতে ওরা অবাক হয়ে গেছে। আমাদের জওয়ানদের ডিউটির কিছু নিয়মানুবর্তিতা আছে। আমাকে ওরা এভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয়”।
ঘরের দরজার ডানদিকে ফলকে বড় বড় করে লেখা “Mr. K K Sarkar, (Commanding Officer)”। ঘরে ঢুকে কনকের বিরাট টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে মুখোমুখি বসলাম। টেবিলে ছোট্ট জাতীয় পতাকাটা জ্বলজ্বল করছে। ঘরটা ভালো করে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে লাগলাম। ওর পেছনের দেওয়ালের ওপর দিকে বড় একটি বোর্ডের দিকে খেয়াল পড়ল। ১৯৮৬ সাল থেকে পরপর যত Officer এই চেয়ারে বসেছেন তাদের নাম ও কার্যকালের মেয়াদ লেখা। প্রথম নামটিই একজন বাঙালীর (A.K.Ghosh)। মাঝে একজন আছেন বটে, একদম শেষে কনকের নাম। মনের মধ্যে কেমন একটা গর্বের অনুভূতি হতে শুরু করল। এই সেই মানুষ যার আতিথেয়তায় আজ আমি এখানে। মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে দানা বাঁধলো যে কনকের কাজটা আরো ভালো করে জানব। জাঁসকারে থাকাকালীন ‘Muney মোনাস্ট্রি’তে দুটো রাত কাটাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখান থেকে ‘ফুগটাল মোনাস্ট্রি’ গিয়েছিলাম। দুর্গে গ্রাম পর্যন্ত গাড়িতে, তারপর হাঁটাপথ। পথে গাড়ি পেতে প্রায় ২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কারণ এ পথে গাড়ি চলে না বললেই চলে। যে গাড়িটি ভাগ্যক্রমে পেয়েছিলাম সেটি ছিল সেনাবাহিনীর মেজরের গাড়ি। দয়াপরবশতঃ তিনি আমাকে লিফট দিয়েছিলেন। পথে যেতে যেতে কাজের তথা দেশের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা প্রত্যক্ষ করতে করতে গেছি। সেনাবাইনীর প্রয়োজনে কোথাও একটা জমির সন্ধানে তিনি চলেছিলেন। তাদের কথাবার্তায় সেটা বুঝতে পারছিলাম। পথটা বেশ দুর্গম। প্রায় পুরো অংশ জুড়েই চলেছে রাস্তা মেরামতির কাজ। কোথাও পাহাড় ড্রিল করে গর্ত করে জিলোটিন দিয়ে ফাটানো হচ্ছে। কোথাও রাস্তার পাথর সরানো হচ্ছে। কোথাও রাস্তার ধার বাঁধানো হচ্ছে। পুরো রাস্তাটাই করছে BRO। তবে লেবাররা সবাই চুক্তিবদ্ধ এবং বাইরের লোক। প্রচুর স্থানীয় মহিলা কাজ পেয়েছে। যেখানেই শ্রমিকরা বসে আছে, তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের বকুনি দিচ্ছেন। বলছেন, “সরকার কী তোমাদের এমনি এমনি টাকা দিচ্ছে”? অথচ এ কাজ তার নয়। এ কাজ দেখার জন্য BRO’র অন্য অফিসার আছে। শেষমেশ সেই অফিসারের ডেরায় গিয়ে আমরা হাজির হলাম। স্থানটি “Amno” এর কাছাকাছি। উচ্চতা লেখা আছে ১৪ হাজার ফুটের ওপর। অফিস বলতে লোহার ফ্রেমের তৈরী বাঙ্কার। শীতকালে এ জায়গা বরফের গভীর আস্তরনে ঢেকে যায়। হঠাৎ বরফ পড়লে যাতে তারা চাপা না পড়ে যায় সে জন্য বাঙ্কারের ভেতর একটা আপাতকালীন দরজা ওপরের দিকে করা আছে। মেজর সাহেবের পরিস্কার অর্ডার কতদিনের মধ্যে কতটা কাজ করতে হবে। এরপর সেই অফিসার নিয়ে চললেন আরো দূরে। চারিধারে সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা অঞ্চলের মধ্যে একটা বিরাট খোলা অংশে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে একটা হেলিপ্যাড আছে। এতক্ষন আমি মেজরের সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলাম। দয়া করে গাড়িতে তুলেছেন। কী বলতে কী বলে ফেলব, ঘাড় ধরে নামিয়ে দিলেই বিপদ। উনিও আমার সাথে কোনো কথা বলেননি। এতক্ষণ পর তার মনে হয়েছে আমার সাথে কথা বলা যায়। ভেবেছেন হয়তো আমি নিখাদ গোবেচারা ভদ্রলোক। বললেন হিমালয়ের এই অংশে এটাই একমাত্র হেলিপ্যাড। কোনো ভি আই পি এলে বা কোনো স্থানীয় মানুষকে উদ্ধার করতে গেলে এই হেলিপ্যাডটিই ব্যাবহৃত হয়। সেই সম্পর্কিত কোনো কাজেই হয়তো তাঁরা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তবে সে সব খোলসা করে কিছু বললেন না। এ ঘটনার উল্লেখ এ জন্যই করলাম যে সেখানে কেউ দেখার নেই, তবু তারা যে যার নিজের কাজে অবিচল। অতএব তাদের কর্তব্যপরায়ণতা সম্পর্কে আমার একটা ধারনা হয়ে গিয়েছিল।
কনকের ডিউটি সকাল ১০টা থেকে। ঘুম থেকে উঠে যোগাসন করে খেয়ে দেয়ে ঠিক ৯.৩০’এ বেরিয়ে যায়। হেঁটেই যায় কাছেই অফিস। তার আগে একজন অফিস বেয়ারা আসে কীসব কাগজ সই করাতে। ওর সকালের কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আমি কাজ সারি যাতে আমার জন্য ওর অসুবিধা না হয়। দুজনের মধ্যে একটা অলিখিত বোঝাপড়া হয়ে গেছিল এসব ব্যাপারে। ওর চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারতাম, সকালের দিকে ও খুব চাপে থাকত। ১১.৩০ থেকে ১২টা পর্যন্ত বেশ টেনশনে কাটাত। ওর উপর হাজারো কাজের ঝামেলা। ওর প্রধান কাজ ছিল Material Control। যেখানের যা কিছু Construction চলছে, তাঁর যাবতীয় ইমারতী দ্রব্য তার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হতো। BRO এর যত গাড়ি চলে, তার ব্যাবস্থাপনা ও ফুয়েল সরবরাহ, প্রতিটি ইউনিটের রেশন দ্রব্য, ক্যান্টিনের সামগ্রী সরবরাহ এসব তাকে দেখতে হতো। সিস্টেমটা এমন চেইন নির্ভর যে কোথাও একটা দ্রব্যের সরবরাহ আটকে গেলে পুরো কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তটস্থ হয়ে থাকতে হতো। এরপর আছে তার বসের হুকুম। তিনি নাকি দুনিয়ার কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যা ৬’টার সময় কনকের কাছে এসে হাজির হন। কনকের ডিউটি শেষ ৫টার সময়। কিন্তু বসের জন্য তার আর ঘরে ফেরা হয় না। বসের সাথে সময় কাটাতে হয়।
এতে অবশ্য একপ্রকার লাভই হতো। পরিবার ছেড়ে একাকী পরিবেশের যে ভয়াবহতা, তা থেকে মুক্তি পেতে সবচেয়ে ভালো উপায় হল যতটা পারা যায় অফিসে সময় কাটানো। আমি যতদিন ছিলাম, সন্ধ্যের পর থেকে আমাকে নিয়ে সময় কাটাতো। ওদের ক্লাবের পার্টি থাকলে কিম্বা ওকে কোনো সহকর্মী নিমন্ত্রণ করলেও ও আমার অজুহাতে যেত না। বলতো আমার বন্ধু এসেছে।
আমার প্ল্যানিং তো অন্যরকম ছিল। আমি তো ভাবিইনি যে কনকের এখানে এভাবে এতদিন থাকব। ভেবেছিলাম মালপত্তর রেখে প্রয়োজনীয়টুকু নিয়ে সাইকেল চালিয়ে পুরো জায়গা ঘুরে আবার এখানে আসব। শেষে সমস্ত কিছু নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরব। ও বলল “এতদূর এসেছিস সাইকেল চালিয়ে, লোকাল জায়গাগুলো আর সাইকেল চালাতে হবে না, আমি গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি ঘুরে নে”। আমি দেখলাম সত্যি কথা বটে। এতে শরীর ও সময় দুটোই বাঁচবে। অনেক বেশি কিছু দেখতে পাব।
কাছাকাছি যে সব গন্তব্য ছিল, তার গাড়ি করেই ঘুরেছি। দুপুরের মধ্যে ঘোরা হয়ে যেত। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম ,গল্প অথবা হাঁটা শুরু হতো। গাড়ি করে মেইন গেট থেকে বেরোবার সময় আমার হতো বেশ বিপদ। কনকের গাড়ি গেট থেকে বেরোবার সময় গেট কিপার জয় হিন্দ বলে স্যালুট ঠুকতেন। আমি যাবার সময় তিনি না বুঝতে পেরে দুএকবার আমাকে স্যালুট করেছেন। যিনি চিনে ফেলতেন যে গাড়িতে আমি আছি তিনি আর ভুল করতেন না। তবে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকতেন। আমার অবস্থাও হতো একই রকম। কী করব বুঝতে না পেরে গেটের কাছে মাথা নামিয়ে মোবাইল দেখার ভান করতাম। গেট পেরিয়ে গেলে মাথা তুলতাম।
কথায় আছে “আরাম হারাম হ্যায়”। এইভাবে থাকতে থাকতে মনটাও বেশ আয়েশী হয়ে উঠছিল। কনককে বললাম “ওরে এভাবে পড়ে থাকলে তো হবে না। দূরের জায়গাগুলো তো যাবো। আর সেগুলো সাইকেলেই তো যাবো”। আমার পরের গন্তব্য ছিল নুব্রা উপত্যকা। ও বলল, “তাহলে তো তোকে খারদুংলা পাস পেরোতে হবে। তুই জানিস? লেহ্ থেকে খারদুংলা টপ প্রায় চল্লিশ কিমি. পুরোটাই খাড়াই”। আমি বললাম আমি সব জেনেই এসেছি, আর আমাকে আটকাস না। ও বলল, “যাবি তো যা, তবে ভালো কথায় বলছি, সারাটা দিন লেগে যাবে। তার চেয়ে কিছুটা রাস্তা গাড়িতে চলে যা, যতটা পারিস”।
আমি দেখলাম মন্দ বলেনি, অনেকটা সময় বেঁচে যাবে। সেই মতো পরেরদিন সকাল সাতটায় পেল্লাই একটা গাড়ি এসে হাজির। আমি বললাম, “ওরে বাপরে, এত উঁচু গাড়িতে আমি সাইকেল সাইকেল তুলবো কী করে রে”। ও বলল, “সে তোকে কে ভাবতে বলেছে”। ড্রাইভার এসে কনককে ‘জয় হিন্দ’ বলে সম্ভাষণ করল। কনক মদনকে ডেকে বলল সাইকেলটা তুলে দিতে। ড্রাইভার সেটিকে কষে বাঁধল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
খারদুংলাতে আমার সবচেয়ে চিন্তা ছিল অক্সিজেনের অভাবের জন্য। শরীরে খুব বেশি চাপ দিয়ে ফেললে সমস্যা হতে পারে কারণ আমি নিজে COPD পেসেন্ট। তাই ড্রাইভারকে বললাম সাউথ পুলু পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। সাউথ পুলু’তে পৌঁছে সে গাড়ি থামালো না, আরো চালিয়ে খারদুংলা টপে তুলে দিল। আমি বললাম কী হলো গো। গাড়ি থামাচ্ছো না কেন। সে বলল, “কম্যান্ডার সাহেবের গাড়ি দাঁড়িয়ে। কে এখানে দাঁড় করাবে। চারটি প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ব”। আমি দেখলাম এ তাদের ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আমার আবদারের জায়গা নয়। জানলাম আজই নাকি কম্যান্ডার সাহেব আমার পথে, আমার সাথে সাথে নুব্রা ভ্যালি চলেছেন। ড্রাইভার আমাকে বলল যে কম্যান্ডার সাহেব এখুনি টপে চলে আসবেন। চলুন আপনাকে নর্থ পুলু পৌঁছে দিই। এখানে জেনে রাখা ভালো যে সাউথ থেকে টপ এবং টপ থেকে নর্থ পুলু দুটোরই দুরত্ব ১৫কিমি। আমি বললাম তোমার সমস্যাটা কোথায়। বলল কম্যান্ডার সাহেবের মুখোমুখি হতে চায় না।
আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন রহস্যজনক মনে হল। কম্যান্ডার সাহেব বাঘ না ভাল্লুক। তাকে এত ভয়ের কী আছে। নর্থ পুলু অবধি যাওয়াতে আমার সময় অনেকাই বেঁচে গেল। ভাবলাম এখন তো শুধু নামা আর নামা। সাঁই সাঁই করে শুধু ব্রেকের ওপর ভর করে তাড়াতাড়ি নেমে যাবো ভাবতেই অ্যাডভেঞ্চার মনটা খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল। কিন্তু হল বিধি বাম। নর্থ পুলুর পর থেকেই রাস্তার কাজ চলছে। রাস্তা খুঁড়ে পাথর বের করা হয়েছে। তার ওপর দিয়ে চলেছি আর কম্পনে আমার সাইকেল খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়। খালি ভাবছি এই বুঝি লিক হয়ে গেল চাকা। মনে মনে BRO কে গালি দিচ্ছি আর বলছি, ব্যাটারা সারা দুনিয়ায় কাজ করে চলেছে তার এই ফল? চালাতেই পারলাম না। প্রায় ২০কিমি. এইভাবে চলার পর ভালো রাস্তা পেলাম, বাকী ৫৫কিমি রাস্তা চালিয়ে একটাই কথা মনে হল ‘BRO জিন্দাবাদ’।
লাদাখ পুরোটাই মিলিটারী ক্ষেত্র বলা যায়। যত সীমান্তের দিকে যাওয়া যায়, ততই এই প্রভাব বাড়তে লাগে। শুধু যুদ্ধ করা বা পরিকাঠামো নির্মাণই নয়, অনেক মানবিক দিকও তাদের আছে। Hunder ছাড়িয়ে যত Turtuk এর দিকে যাওয়া যায়, সেখানে ‘9Post’ বলে একটি জায়গায় শিখ রেজিমেন্ট আছে যার পরে একটা বিরাট অংশ জনবসতিহীন। এই 9 Post অঞ্চলে মিলিটারিরা একটি ক্যান্টিন চালায় পথযাত্রীদের সুবিধার জন্য। সেখানে ম্যাগি, চা, পকোড়া, সিঙাড়া জিলিপি, এগ টোস্ট, বাটার টোস্ট ইত্যাদি পাওয়া যায়। ওই পথে চলাচলরত এমন কোনো যাত্রী নেই যারা এখানে এক পলক দাঁড়ায় না এবং কিছু খায় না। আর্থিক লাভের জন্য নয়, সামান্য মূল্যে সে ক্যান্টিনে খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কে কী নিচ্ছে তার হিসেবও সব সময় তারা রাখে না। আমার দুঃসাহসিক সাইকেল অভিযানের কাহিনী শুনে তারা তো আমাকে নিজেদের জায়গায় বসিয়ে দুপুরে পেট পুরে খাইয়ে দিল। অতএব তাদের কাজ মূলত পরিষেবা প্রদান।
Hunder থেকে লেহ্ ফেরার সময় আমার যাবার কথা ছিল সিয়াচেন হিমবাহের রাস্তায় পানামিক গ্রাম পর্যন্ত। কনকের ফোন এল। Hunder থেকে নাকি একটা গাড়ি Spituk (কনকের অফিস) যাচ্ছে। বলল আমার কথা ও ইতিমধ্যে বলে রেখেছে। আমাকে নিয়ে পানামিকের রাস্তায় আমি যা দেখতে চাই তা দেখিয়ে আমাকে লেহ্ পৌঁছে দেবে। অনেক যুক্তি তর্ক সাজিয়ে দেখলাম এতে আমার তিনদিন সময় বাঁচবে। সেটাও কম নয়। তবে খারদুংলা টপ থেকে আমাকে সাইকেল চালাতে দিতে হবে সেই শর্তে রাজি হয়ে গেলাম।
প্রথমে ঠিক ছিল সকাল চারটেতে বের হব। তাদের আবার সময় কাঁটায় কাঁটায়। কিন্তু সিভিলিয়ানদের তারা চেনে। আমরা যে সব সময় সঠিক সময় মেনে চলতে পারি না তারা বোধহয় সেটা জানে। তাই ড্রাইভার আমাকে বলল “সাব, সাচ সাচ বাতাইয়ে কিতনা বাজে আপ যায়েঙ্গে। কিউকি ইত্না সুভে উঠকে খাড়া রাহেনা আচ্ছা নেহি লাগতা। আপ যো বলেঙ্গে উস টাইম পেই ম্যায় খাড়া রাউঙ্গা”। আমি বললাম ৬.৩০’এ এসো।
আমি ৬ টা থেকে তৈরী হয়ে বসে আছি। ৬-৩০ এ বাইরে বেরিয়ে পায়চারি করছি। ড্রাইভারের পাত্তা নেই। এটা অভাবনীয়। মনে মনে ভাবছি আমি নিজে মিলিটারি নিয়ম পালন করি, আর ড্রাইভার মিলিটারি হয়ে দেরী করছে কেন। এরপর গেস্টহাউসের হাবিলদারের ফোন। আমাকে ড্রাইভার ৬-৩০টা থেকে ফোনে চেষ্টা করছে, পাচ্ছে না। এ অঞ্চলে টাওয়ারের খুব সমস্যা। আমি বললাম এখুনি তাকে আসতে বলো।
শিখ ড্রাইভারটিকে সব বুঝিয়ে বললাম। সে খুব যত্ন করে সাইকেলটিকে গাড়িতে তুলে বাঁধল। আমি কেবিনে বসলাম। এরপর যাত্রা শুরু হল। যাওয়ার পথে আবার এক সাহেবের পাল্লায় পড়লাম। তিনি হলেন LT. Col. Neggi। Hunder এ আমি যে BRO ক্যাম্পে ছিলাম, উনি সেখানকার OC। যেমন কনক হল Spituk এর ক্যাম্পের OC। উনি নাকি ওইদিন লেহ্ থেকে ফিরবেন।
আমার গাড়ির ড্রাইভার গুরবিন্দর সিং সারা রাস্তা খোঁজ চালাতে লাগল যে নেগী সাহেব কতদূর আছেন। OC সাহেব কখন কোথায় থাকেন সেটা সবার জানার কথা নয়। যেহেতু গুরবিন্দর জেনে ফেলেছে নেগী সাহেবের আগমন বার্তা, সে তটস্থ হয়ে চালাতে লাগল। বাকী BRO গাড়ীগুলোকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল সাহেব কতদূর। রাস্তায় যারা কাজ করছে তাদের সে সাবধান করতে করতে চলতে লাগল এই বলে যে, “সাহাব আ রাহা হ্যায়। OC সাহাব আ রাহা হ্যায়। সাবধান”। বাকী যে BRO গাড়ী যাচ্ছে তারা যদি না জানে তবে তাদের বলতে বলতে চলেছে OC সাহেবের খবর।
আমি বেশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা গুরবিন্দজী, আপনি এরকম করছেন কেন? OC সাহেব আসবেন তো কী আছে? তিনি তার কাজ মতো আসছেন। আপনি আপনার কাজ মতো যাবেন। এতে এত ভয়ের কী আছে”? তিনি বললেন OC সাহেবদের সম্মুখীন হতে নেই। তাদের মর্জি। এখুনি গাড়ী দাঁড় করিয়ে চেকিং করতে পারেন। হাজারো প্রশ্ন করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা তাদের মুড মতো উত্তর দিতে না পারলে বকুনী। সব সময় সবকিছু তথ্য মনে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া আপনি বাহিনীর লোক নন সেটা দেখেই চিনতে পারবেন। তখন আমাকে দাঁড় করাবেনই করাবেন। ব্যাস তারপরেই শুরু হবে প্রশ্ন। আমি বললাম আমাকে তিনি চিনবেন কী করে? তিনি বললেন, “আপনাকে দেখেই চিনবেন। প্রথমত আপনি স্যালুট করবেন না। যদিও বা করেন, স্যালুটের ধরন দেখে চেনা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা আপনি সিভিল ড্রেসে আছেন”। আমি গুরবিন্দর ভাইকে বললাম আপনার কোনো চিন্তা নেই। Spituk এর OC সরকার সাব নেগী সাব কে আমার কথা সব জানিয়েছে। আপনার অত ভয় পাবার কিছু নেই। অন্তত আমাকে নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা নেই। সে বলল আপনি সরকার সাহেবের দোস্ত সে আমারা জানি। উনি বহুত আচ্ছা আদমি। আপনাকে নিয়ে আমার কী আর সমস্যা। আসলে OC সাহেবদের সামনে আসা মানেই ঝামেলা।
এইভাবে গাড়ী খারদুংলার পথে এগোচ্ছে। গুরবিন্দরের দৃষ্টি বহুদুরে যত গাড়ী আসছে সে দিকে। মাঝে মধ্যেই বলে উঠছে, “লাগতা হ্যায় অহি গাড়ী হি হোগা”। তারপর বলছে নেহি নেহি। এই করতে করতে একটা কালো স্করপিও দেখা গেল বহুদুরে। ও বলল ওই ওই ওইটা। আমিও তার সাথে সাথে কেমন একটা তটস্থ হয়ে গেলাম। ভাবছি আমিও কেন ড্রাইভারের মতো করছি রে বাবা। আমি কী চাকরী করি নাকি। ভুল ভাঙ্গলো গাড়ীটা কাছে আসতে। তিনি বললেন এটা OC সাহেবের গাড়ী নয়। কিন্তু তার মিনিট পাঁচেক পরে একটা গাড়ী দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল যে ওটাই OC সাহেবের গাড়ী। আমি বুঝলাম এবার সিনেমার ক্লাইম্যাক্স আসতে চলেছে। দেখা যাক এতক্ষণের উৎকণ্ঠার অবসান কী ভাবে হয়।
ধীরে ধীরে OC সাহেবের গাড়ী পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে আসতে লাগল। গুরবিন্দরের মুখের ভাষা পরিবর্তন হল। কেমন একটা শক্ত চোয়ালে সীটে সোজা হয়ে গেলেন। তার দেখাদেখি আমার কেমন একটা হতে লাগল। সেটা কোনো ভয় নয়, সেটা ভক্তি। একটা চেয়ারের কত বড় ক্ষমতা হতে পারে যে একজন ড্রাইভারকে এতটা সজাগ রাখতে পারে। তবেই না একটা বাহিনী এত অনুশাসনের মধ্যে থাকতে পারে।
গাড়ীটা একদম সামনে চলে এল। গুরবিন্দর স্টিয়ারিং এর ওপর হাত রেখে কাঁধ থেকে কবজি পর্যন্ত একদম সিধে করে নিজেকে একটা ঝাঁকুনি দিল এক সেকেন্ডের জন্য। সাহেবদের সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট করাটা বাহিনীর অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু ড্রাইভারদের জন্য নিয়ম হল, যেহেতু তার স্টিয়ারিং ছাড়লে বিপদ তাই স্টিয়ারিং এর ওপর হাত রেখে হাতটা সোজা ও শক্ত করতে হয়। এটাই তাদের স্যালুট। যারা বাহিনীর লোক তারা এতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার চোখের সামনে থেকে দেখা এই দৃশ্য মনের মধ্যে একটা অন্য অনুভুতি এনে দিল। প্রথমে ভাবছিলাম আমার কী করণীয়। আমি কি মাথাটা নিচু করে রাখব? সাহেবদের চক্করে পরার আমারই বা কী দরকার। কিন্তু কৌতুহলবশতঃ তাকাতেই দেখি তিনিও আমার দিকে প্যাট প্যাট করে দেখছেন। ভাবছেন এই সেই সরকার সাহেবের দোস্ত।
সে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মুখোমুখি। সামনে দিয়ে গাড়ীটা হুস্ করে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “ঝামেলা খতম”। আমি বললাম আজ যে কিছু ঝামেলা হবে না জানতাম, তবে আপনি এমন করছিলেন যে আমিও ঘাবড়ে গেছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কী রকম ঝামেলায় পড়েছেন। তিনি বললেন এ সাব দাঁড় করিয়ে গাড়ী নিরীক্ষণ করেন। মদ খেয়েছি কি না দেখেন। তবে উনি আমাকে চেনেন। আমাকে কখনো মদের জন্য চেক করেননি। সাহেবদের জন্য এই যে ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম লক্ষ্য করেছিলাম তাতে কনকের জন্য চেয়ারের জন্য গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছিল। এত সম্মানজনক একটা কাজে কর্মরত মানুষ আমার সহপাঠী এবং কয়েকদিন আমি তার ঘরে দিনযাপন করছি এতে নিজের প্রতি নিজের সম্মান বেড়ে গেল। কনককে এই পুরো ঘটনাটা বলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোকে দেখেও ড্রাইভারেরা এ রকম ভয় পায়? ও বলল, “ হ্যাঁ। ওদের চেক করাটা আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে। ড্রিংক করে গাড়ী চালালে সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড করে দিই”।
আমার সাইকেলে ফেরার প্ল্যান বাতিল করতে হল বৃষ্টির জন্য। কনক বলল ওদের ডিপার্টমেন্টের বাস ছাড়ে সপ্তাহে একটা করে। শনিবার লেহ্ থেকে ছেড়ে মানালিতে রাত্রিবাস। আবার পরদিন সকালে ছেড়ে সন্ধ্যেবেলা চন্ডিগড়। নিজেই ফট্ করে চন্ডিগড় থেকে আমার জন্য ট্রেনের একটা টিকিট কেটে ফেলল। আমি বললাম ইচ্ছে ছিল সাইকেলে করে মানালি হয়ে বাড়ি ফিরব। ও বলল হিমাচলে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় ধস নামছে। ওদের গাড়ী আটকে পড়েছে। লেহ্তেও দুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝপথে ওঠা যাবে না। চন্ডিগড় যেতে গেলে এখান থেকেই উঠতে হবে। দু একবার বলার চেষ্টা করলাম যে সাইকেলে যাবার মায়া ত্যাগ করতে পারছি না। দেখলাম গম্ভীর হয়ে চোখটা বুজে কনক উত্তর দিল “যা চলে যা। বাসের বুকিং ক্যনসেল করে দিচ্ছি”। বুঝলাম এবার ও সিরিয়াস হয়ে গেছে। আর কথা বাড়ালাম না।
বাস ছাড়ার সময় রাত তিনটে। আমি রাত দুটোয় উঠলাম। প্রস্তুত হয়ে বসে আছি ঠিক ২-৪৫ এ বেরোবো বলে। ভাবছি, কে জানে বাস কখন আসবে। এত রাতে ড্রাইভার ঘুম থেকে উঠেছে তো? রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থাকতে হয়। ২-৪৫ এ কনককে ঘুম থেকে ডেকে বলতে যাবো যে ওঠ। আমি তৈরী, দরজা খোল। সেই মুহূর্তে কনকের ফোন বেজে উঠল। ওপার থেকে কেউ বলল “সাব আপকা দোস্ত কা যানে কা বাত হ্যায়। উনকো আনে বলিয়ে”। ওরা হয়ত ভাবছিল আমি সিভিল মানুষ। যদি সময়ে হাজির হতে না পারি। ধড়মড় করে উঠে কনক বলল চল চল ওরা ডাকছে। আগের দিন কাজের লোক মদন গিয়ে বড় লাগেজ বাসে তুলে এসেছিল। আজ রাতের লাগেজটা কনক আর আমি দুজনে মিলে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। একটা লোক দেখি দৌড়ে দৌড়ে আমাদের দিকে আসছে। কনক বলল “ওই এসে গেছে”। সে এসে আমাদের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। আর একজন দৌড়ে এসে আমার দিকে দুহাত বাড়ালো। আমি ভাবলাম করমর্দন করতে চাইছে। আমিও আমার হাত বাড়িয়ে দিতে সে কেমন একটা ঘাবড়ে গিয়ে হ্যান্ডসেক করল বটে, কিন্তু একটু মুচকি হেসে ফেলল। কনক বলল, “ওরে হ্যান্ডসেক কে করতে বলেছে। ও তোর পিঠের ব্যাগটা বইতে এসেছে”। আমি বললাম আরে না না। এর কোনো দরকার নেই। এই ছোট্ট ব্যাগটা আমিই নিয়ে যাচ্ছি। বলতে সে জওয়ান দৌড়ে আমাদের আগে আগে বাসে চলে গেল। কনক বলল “মাঝরাতে একটা কীর্তি করলি বটে। ওরা আমার স্টাফ। তোর দেখভাল ওরাই করবে”।
বাস ছাড়ল কাঁটায় কাঁটায় ঠিক তিনটে’তে। মনে পড়ল আমি এখন জওয়ানদের গাড়ীর সওয়ারি। গোটা বাসে আমরা ছিলাম দশজন। লিস্টের নাম ধরে ধরে প্রত্যেকের নাম ডাকা হল। একজনের ভার ছিল আমাকে দেখার। সুবিধে অসুবিধে মতো সে আমার দেখভাল করতে লাগল। কনকের প্রশংসায় সে পঞ্চমুখ হয়ে বলল এরকম বস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ বস বলেণ ঝুট মাত বোলো। যো হোগা সাচ সাচ বাতাও। আগার কুছ গালতি হোগা তো ম্যায় সামাল লুঙ্গা। আগের বস নাকি ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সটকে যেতেন। আমি বুঝলাম আমার যে এত সম্মান তা কনকের জন্যই।
এই বাসে যাবার সবচেয়ে সুবিধা হল যে কোনো চেক পোস্টে দাঁড়াতে হচ্ছে না। শুধু “ GREF” এর গাড়ী বললেই হচ্ছে। মানালিতে ঢোকার আগে যে পাস তার নাম রোটাং পাস। রোটাং পাস যাতে টপকাতে না হয় তার জন্য বর্তমানে ‘অটল ট্যানেল’ নির্মাণ করা হয়েছে। অটল ট্যানেলে যখন ঢুকলাম এক রকম পরিবেশ। এগারো কিমি দীর্ঘ এই ট্যানেলটি শেষ হয়ে যেই অন্য মুখে বেরোলাম, মনে হল যেন একটা অন্য দেশে এলাম। কুয়াসা ও মেঘে ঢাকা চারিধারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আর তেমন বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে কনকের কথা মনে এল। ভাগ্যিস ওর কথা শুনেছিলাম। ওদের কাছে সাম্প্রতিক আপডেট থাকে। এই পরিবেশে সাইকেল চালানো অসম্ভব। অথচ ট্যানেলের ওপারে মনটা ছটফট করছিল সাইকেলের জন্য।
মানালিতে বাস থামল। রাত্রি যাপন করলাম তাদের মেসে। পরদিন সকাল ৫’টায় বাস ছেড়ে চন্ডিগড়ে এলাম দুপুর ২টো নাগাদ। পুরো রাস্তাটাই বৃষ্টি। চন্ডিগড়েও তাদের মেসে খাবার বন্দোবস্ত করা ছিল। ৭’টার সময় তারাই নিজেদের গাড়ী করে আমাকে চন্ডিগড় স্টেশনে পৌঁছে দিল। সেদিন রাতে ছিল আমার ট্রেন।
বেশ কিছুদিন আমার সৌভাগ্য হল BRO বাহিনীর সাথে কাটানোর। সিভিল জীবনে বিলাসিতা ও স্বেছার বশবর্তী দিন যাপনকারী আমরা বুঝতেও পারি না দেশ মাতৃকাকে রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকা সরকার খরচ করছে এবং এই সেনাবাহিনীর মানুষজন তার কর্তব্য পালনের জন্য ঘর সংসার ছেড়ে দিনের পর দিন একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে চলেছে। যে নিয়মানুবর্তিতায় তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তাতে তারা চাকরী ছেড়ে আমাদের মধ্যে মানিয়ে নিতে অনেকেই অসুবিধায় পড়ে। শুধু টাকার জন্য সেনা বাহিনীর চাকরী করা যায় না। একটা দায়বদ্ধতা, দেশের প্রতি একটা ন্যুনতম ভক্তি তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা হয়। নাহলে নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ জীবন দিনের পর দিন যাপন কোনো মতেই সম্ভব নয়।