একটি চুরি যাওয়া সাইকেল

একটি চুরি যাওয়া সাইকেল

পর্ব - ৩

এখানে SSB এর টিমটা সকাল ৬’টায় চলে আসে। সন্ধ্যে ৬’টায় চলে যায়। সকাল বেলা এসেই তারা কলকল করতে শুরু করে। ফলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এরা অসমের ব্যাটেলিয়ান। এখানে এসেছে অমরনাথ যাত্রা চলাকালীন যাত্রী সুরক্ষার জন্য। তাদের দশজন পুলিশ ক্যাম্পেই থাকে। জায়গা নেই বলে বাকিরা নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। বিকেলে যখন লাইন দিয়ে সারিবদ্ধভাবে যায়, দেখতে দারুণ লাগে। পুলিশ ক্যাম্পের যে ঘরটায় এরা আছে, আমি তারই ছাদের ওপর টেন্ট খাটিয়ে আছি।

     সকাল ৬’টায় তাদের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গার পরে আমার কোনো কাজ নেই। তাই টেন্টের ভেতরেই চুপটি করে শুয়ে আছি। তারা যে যার নিজের মতো করে গল্প করে চলেছে। কেউ কেউ আমাকে নিয়েও মন্তব্য করছে। টেন্টের চারদিক ঢাকা বলে তারা ঠিক বুঝতে পারছে না ভেতরে আমি আছি কি নেই। একজন বলে বসল, “আরে এরা এরকমই। যেখানে সেখানে রয়ে যায়। কোনো কাজ নেই। তারপর ঝামেলায় পড়লে আমাদের সামলাতে হয়”। বাঙালী রতনবাবু দেখি তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন, “তুই কি সব জেনে গেছিস? কার সম্বন্ধে কি বলছিস? এ পণ্ডিত মানুষ। কাল কথা বলেছি। তোরা সবাইকে এক করে ফেলিস কেন”।

     এদের রোজ সকাল বিকেল টিফিন আসে ক্যাম্প থেকে। রুটি, তরকারি, কলা, আপেল ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার জন্যও জুটতে লাগলো সে সব। আমি যেন ওদেরই একজন হয়ে গেছি। একসাথে গল্প করছি। পরদিন সকাল ৯’টা বাজে। দেখি SHO সর্দার স্বরূপ সিংজী এসে হাজির। সঙ্গে পাঁচ ছয়জন পুলিশ। আমাকে তাঁরা ডাকলেন শিষ দিয়ে। এটা তাদের একটা স্টাইল। কাছে যেতে সর্দারজী বললেন, “আপনি এখন কী করবেন সন্দীপজী”? আমি জিজ্ঞাসা করলাম সাইকেল কি পাওয়া গেছে? উনি বললেন, “না”। আমি বেশ হতাশ হলাম। তবুও তারা যে আমার জন্য চেষ্টা করেছেন সেটাই আমার মনে হয়েছে প্রাপ্তি। আমি বললাম তাহলে স্যার আমি ফিরে যাবো। কারণ আমার ট্যুরটাই তো সাইকেলের। তাছাড়া এতো মালপত্তর নিয়ে আমি কোথায় যাবো। বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভালো। উনি বললেন তাহলে চলুন, অফিসে কিছু কাগজপত্রে সই করতে হবে।

     সবাই মিলে চললাম অফিসে। অফিসে ঢোকার আগে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও পড়লাম দাঁড়িয়ে। আমি বুঝতে পারছিনা আমার কি করণীয়। মুন্সিজী বললেন কালো গাড়িটার দিকে যেতে। সেদিকে গিয়ে গাড়িটার ফাঁক দিয়ে একটা হ্যান্ডেল কেমন চেনা চেনা লাগলো। দৌড়ে গাড়ির পেছন দিকে গিয়ে দেখি আমার সাইকেলটা। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে সাইকেলটাকে আমি আবার দেখতে পাচ্ছি। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পাওয়ার একটা অনুভূতি এলো মনে। মনে হল, কেনার পরের দিন থেকে একটা রাতের জন্যও সে আমার ঘর ছাড়া হয়নি। এই প্রথম সে আমাকে ছাড়া রাত কাটালো। না জানি কত কষ্ট হয়েছে তার। না জানি কত অত্যাচার করা হয়েছে তার ওপর। এত বিস্তৃত এই বর্ণনা যতটা দীর্ঘ হচ্ছে, তার সারমর্ম আমার মনে এক মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ গতিতে খেলে গেল। মায়ার চোখে সাইকেলটার গায়ে হাত রাখলাম। চোখে জন চলে এলো। মাথাটা নিচু করে কাঁদতে শুরু করলাম। কান্নাটা থামতে একটু সময় লাগছিল। এক অফিসার আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। সর্দারজী বললেন, “থাক থাক। একেই বলে attachment. ওনাকে কাঁদতে দিন”।

     সর্দারজীর দিকে চোখ গেল। দেখি উনি আমার অনুভুতিকে ভিডিও করে রাখছেন। আমার মনে হল, যা কিছু ফিরে পাওয়া সবই তো এনার জন্য। মাথা নিচু অবস্থায় তার পা দুটো চোখে পড়ল। হাতটা আপনা থেকেই তার পায়ে চলে গেল। নিমেষে তিনি পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আরে করছেন কী, করছেন কী। আপনার স্থান ওখানে নয়, আমার বুকে। আপনি হলেন রবীন্দ্রনাথ টেগরের দেশের লোক”। এই বলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বর্তমানে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবময় অতীতের কতটা যোগ্য উত্তরসূরি সেটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।

     সাইকেল আমি দেখলাম বটে তবে তা হাতে পেলাম না। যেহেতু FIR হয়েছে অতএব সেটি নাকি কোর্টে গিয়ে ছাড়াতে হবে। চলে এলাম টেন্টের কাছে। SSB এর জওয়ানরা ছেঁকে ধরলো। সাইকেল ফিরে পেয়েছি শুনে আনন্দে তারা আত্মহারা। দু একজন এক হাতে রাইফেল সমেত দু হাত তুলে লাফিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবছি আনন্দে শূন্যে না গুলি ছুঁড়ে বসে। যেন কোনো যুদ্ধ জয়ের খবর এসে পৌছল তাদের কাছে। যুদ্ধ জয়ই বটে। এ পাহাড় থেকে সাইকেল উদ্ধার যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম কিছু নয়। রতনবাবু বললেন, “বলেছিলুম, এ সর্দারজী অন্য ধাতুতে গড়া। এ যা মনে করবে তা করে ছাড়বে”।

     সেদিন আমার কোনো কাজ নেই। SSB এর সাথেই দিন কাটাবো। কোথাও যেতেও ইচ্ছা করছে না। দেখারও কিছু নেই। তবে এখান থেকে ট্রেকিং করার অনেক জায়গা আছে। এখানে “POGOL” বলে একটি জায়গা আছে যেটি পাহাড়ের ওপর। সেখানে টেন্ট করে থাকা যায়। আমরা সবাই এ জায়গার নাম না জানলেও অনেক বিদেশী নাকি ওখানে আসে থাকার জন্য। SSB’রা বলছিল এখানে বসে না থেকে যান ওখানে ঘুরে আসুন। আমার তখন ঘোরা মাথায়। ভাবছি ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরলে হয়। বরং এখানে SSB এর খুনসুটি দেখতে লাগলাম।

     তাদের কেউ কেউ আছে বেশ রসিক। একজনের বাড়ি বিহারের সীতামারিতে। নিজেদের মধ্যে সে আলোচনা করছিল যে সে নাকি জীবনে মশা মারেনি। উড়িয়ে দেয়। জীবনে কখনো মশা মারার ধূপ ব্যবহার করেনি। তাতে মশা হত্যা করা হবে। বাকিরা মন দিয়ে তার কথা শুনছিল। আমি এরকম চরিত্র আগে কখনো দেখিনি যে কেউ জীবনে একটাও মশা মারেনি। মশার প্রতি এত যার প্রেম তার সাথে একবার কথা বলতেই হবে। তার হাতের একটা ফোলা দেখিয়ে বললাম এটা তো মশার কামড় মনে হচ্ছে। এই মশাটা কি শেষ অবধি রক্ত খেয়েছে নাকি উড়িয়ে দিয়েছেন? উনি বললেন আপনি লেখক মানুষ। এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আপনার অভিজ্ঞতা বলুন। এসব মশার গল্পে আপনাকে ঢুকতে হবে না। বাকিরা হাসতে লাগলো। পাশ থেকে আর একজন বলল, “আরে যত্ত সব গুল গাপ্পি মারছে। আপনি বুঝতেই পারছেন না”। আমি বেশ বোকা বনে গেলুম। এত সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছিল এবং বাকিরা এত মন দিয়ে সে আলোচনা চালাচ্ছিল, আমি একটু বোকা বনেছি বটে। তবে তাদের জীবনকে এত কাছে থেকে দেখতে পাচ্ছি এটা ভালো লাগছে। বন্দুক হাতে যতই শত্রু নিধন করুক, তাদের ভেতরেও একটা শিশু আছে, সেটা দেখতে পাচ্ছি। কেউ গম্ভীর, কেউ সাহসী, কেউ ভীতু, কেউ রসিক, কেউ ব্যবহার শেখেনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

     যেমন গয়ার একটি ছেলে। ছুঁড়ে ছুঁড়ে কথা বলে। একদিন চটিটা খুলে রেখেছি, না বলেই পরে চলে গেল। আমি ধরেই নিলাম সেটা হয় আমি কোথাও খুলে রেখে এসেছি। ভুলে গেছি। অথবা কেউ চুরি করে নিয়েছে। কিন্তু সে আর বলি কাকে। খালি পায়েই ঘুরছি। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি সে দিব্যি আমার চটি পায়ে গলিয়ে ঘুরছে। রতনবাবু টাই দেখে দিলেন তাকে দু এক কথা শুনিয়ে। যখন প্রথম টেন্ট খাটিয়েছিলাম, না বলেই সে টেন্টে ঢুকে পড়েছিল। সে কি বিপদ। দিব্যি বাবু হয়ে বসে আছে। ও না বের হলে আমি ঢুকতেও পারছিনা। একদিন ওষুধ খাচ্ছি, দুম করে বলে বসল, “এই যে বললেন আপনি এত ফিট, তাহলে ওষুধ খান কেন”। ওর সব কথার উত্তর আমি দিতাম না। আমার সাইকেলের দাম নিয়ে কথা হচ্ছিল। ও বলল, ও নাকি একটা সাইকেল দেখেছে যেটা এগারো লাখ টাকা দাম। সেই শুনে তার সহকর্মীরা তাকে প্রণাম করে বলল, এবার থাম। আর দাম বাড়াস না। কদিন আগে বলেছিলি ৮ লাখ। তার আগে বলেছিলি ৩ লাখ।

     এখানে বিহারের অনেকে আছে দেখলাম। আর একজনের বাড়িও গয়াতে। তার আত্মীয় আবার হাওড়াতে থাকে। ফোন করে তার সাথে আমার কথা বলালো। বেশ উৎফুল্ল মনে হল তাকে। থানাটাকে দেখে এমনিতে মনে হয় বেশ ফাঁকা। কিন্তু রোজই দেখি নতুন মুখ। তারমানে পুলিশের সংখ্যা ভালোই। সকলেই জানে যে আমার সাইকেল চুরি গেছে এবং পাওয়া গেছে। তবু সকলেই জিজ্ঞাসা করছে চলে যাচ্ছিনা কেন। সকলকেই বলতে হচ্ছে, কোর্টে গিয়ে সাইকেল ছাড়াতে হবে।

     পরদিন সকালে কোর্টে যাবো সাইকেল ছাড়াতে। মুন্সি পরিহার সাহেব এসে আমাকে বললেন কোর্টে চলে যেতে। সকাল সকাল চলে গেলে সকাল সকাল কাজ হবে। কারণ কোর্টে গিয়ে ওরা একটা কাগজ দেবে। সেটা নাকি আমাকে আবার এই Ramsoo থানায় আনতে হবে। সেটা দেখে এরা তখন আর একটা কাগজ দেবে। সেটা নিয়ে আবার কোর্টে যেতে হবে। কোর্ট তখন সাইকেল রিলিজ অর্ডার দেবে। সেটা নিয়ে এলে তবেই থানা থেকে সাইকেল ছাড়াতে পারবো। এটা আমার কাছে নতুন। তবে যারা ওকালতি করে, তাদের এটা জানা পদ্ধতি। তবে শুনে মনে হচ্ছে যেন ট্রেনে চেপে মামারবাড়ী যাওয়া আর আসা। একবার নয়। দু দুবার কোর্টে যেতে হবে। তাও আবার নিজে নিজে। এখানে কিছুই চিনিনা। কাল থেকে ভেবে আসছি পুরো দায়িত্বটাই থানার। ওরাই বোধহয় আমাকে জামাই আদর করে গাড়ি করে নিয়ে যাবে। একা যেতে হবে শুনে আমার পিলে গেল চমকে।

     একে ওকে জিজ্ঞাসা করে যা বুঝলাম, এখান থেকে হেঁটে দু কিমি দূরে “Magarkot” গ্রামে যেতে হবে শ্রীনগর-জম্মু সড়ক বরাবর। তারপর সেখান থেকে ট্রেকারে অথবা বাসে করে পাহাড়ের ওপরে ১০ কিমি দূরে “Ukhral” বলে একটি জায়গা, সেখানে কোর্টে যেতে হবে। SSB এর রতনবাবু বললেন ওখান থেকে আরও ৮ – ১০ কিমি ওপরে গেলে Pogol. সেটা নাকি স্বর্গরাজ্য। শেষ কিছুটা হাঁটা পথে গিয়ে টেন্ট করে থাকলে মন জুড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবছি, আমি মরছি আমার জ্বালায়, আর উনি আমাকে পোগলের গল্প শোনাছেন।

     সকাল ৯.৩০ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। Magarkot গিয়েই দেখি একটা ট্রেকার ছাড়বে ছাড়বে করছে। তাতে উঠে বসলাম। পুরো পাহাড়ি খাড়া রাস্তায় গাড়ি উঠতে শুরু করলো এঁকে বেঁকে। কিছু অংশ পিচের, কিছু অংশ মাটির। Ukhral পৌঁছে কোর্টে যেতে যেতে ১.০৩০’টা বেজে গেল।

     Ramsoo’তে পরিহার সাহেবকে বলেছিলাম, আমি যে নিজের মতো কোর্টে যাচ্ছি, আমার কাছে তো কিছু কাগজ থাকা জরুরি যাতে লেখা থাকবে আমার কোর্টে যাবার উদ্দেশ্যটা কী। খালি হাতে আমি কাকে কি বলবো? উনি বললেন কোনো একটা উকিলকে গিয়ে বলতে যে আপনি সাইকেল ছাড়াতে এসেছেন। কোর্টে সব বলা আছে। তবুও আমি বললাম, “না চিনি কোর্ট, না চিনি উকিল। কারো একটা নাম তো বলুন যার সাথে দেখা করব গিয়ে”। এই বলাতে তিনি কারো একজনের সাথে ফোনে কি সব কথা বলে তার নম্বরটা আমাকে দিলেন। তার নাম হল “কাউম সোহেল” সাহেব। তিনি J & K পুলিশের লোক এবং তাকে নাকি সবকিছু বলা আছে। আমি এবার তাও একটা কিছু হদিশ পেলাম যাবার।

কোর্টে গিয়ে কাউম সাহেবের সাথে দেখা করতে উনি বেশ সম্মানের সাথে আমাকে বললেন, যে কোনো একটা উকিলকে গিয়ে সমস্যাটা বলতে। তিনিই যা করার করে দেবেন। বুঝলাম কোর্টের লোক হয়ে কোন উকিলের কাছে যেতে হবে সেটা তাঁরা বলতে পারেন না। এটা আমাকেই বেছে নিতে হবে। এখানে কোর্ট বলতে একটা ছোট বাড়ি। তার দাওয়ায় জনা ত্রিশেক লোক বসে। একটা চেয়ারে একজনই মাত্র উকিল কালো কোর্ট পরে বসে আছেন। তাঁকে গিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু বলাতে তিনি বসতে বললেন। তারপর সব শুনে বললেন, ঠিক আছে। হয়ে যাবে। তবে একটু সময় লাগবে। কারণ এখানে আজ বিদ্যুৎ নেই বলে নেট চলছে না। আমার কাজের জন্য ই-স্ট্যাম্প লাগবে। সেটা আনতে ১ কিমি ওপরে যেতে হবে। আমি ভাবলাম ১ কিমি ওপরে যেতে কত আর সময় লাগবে। চেষ্টা করবো কোর্ট থেকে অর্ডারটা নিয়ে গিয়ে থানা থেকে যা হোক করে আজকেই কি একটা কাগজ দেবে, সেটা নিয়ে ৪’টের মধ্যেই কোর্টে চলে আসবো। হাতে অনেক সময় আছে। দিব্যি চেয়ারে বসে কোর্টের কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম।

এখানের কোর্ট আমাদের শহরের কোর্টের মতো নয়। পাহাড়ের ধাপে একটা বাংলো ধরনের বাড়িতে কোর্ট চলে। ভাড়া নেওয়া আছে। যদিও নিজস্ব ভবনের জন্য নির্মাণকাজ চলছে। বাংলোর সামনে একটা উঠোন মতো আছে। পাশ দিয়ে নিচু জমিতে নালার মতো জল বয়ে চলেছে। সবাই এই উঠোনেই সারি দিয়ে বসে আছে। যার যেমন ডাক পড়ছে, সে তেমন দৌড়চ্ছে। কোর্টের ভেতরে মামলা সংক্রান্ত লোকজন ছাড়া সাধারণ লোকের যাওয়া বারণ।

একতলায় অফিসের কাজকর্ম হয়। দোতলায় জজ সাহেব বসেন। যার যখন মামলার ডাক হয়, ওপর থেকে জানলা দিয়ে একজন চেঁচিয়ে হাঁক পাড়ে। যার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, সে তখন নিচে থেকে দৌড় মারে ওপরে। যাবার সময় সিঁড়ির নিচে একটা কাগজের বাক্সে মোবাইল রেখে যেতে হয়। নিশ্চিন্তে সবাই যায়। কেউ কারো মোবাইলে হাত দেয়না।

এখানে কিছু কিছু কেস জমি-জমা সংক্রান্ত। কিন্তু বেশিরভাগ কেস হল স্বামী-স্ত্রী সংক্রান্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েগুলো কেস করে ছেলেদের অত্যাচারে। শুধু ডিভোর্সের মামলা নয়। বেশিরভাগই ক্রাইমের মামলা। বরগুলো বউগুলোকে ধরে পেটায়। বোধহয় এখানের ছেলেগুলোর মাথা গরম। তবু ভালো যে মেয়েগুলো থানা ও কোর্টে আসে। নিজেরা কিছু করে বসে না।

     আমার উকিল সাহেবের নাম সুনীল সিং। তিনি যে চেয়ারে বসেন, তার পাশের একটি চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন। আমি সেখানে বসে সবকিছু দেখতে লাগলাম কারণ যা কিছু হচ্ছে সবই আমার সামনে। একটি বছর ত্রিশের মেয়ে তার বাবাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে বাপেরবাড়ি চলে এসেছে। উকিলের কাছে এসেছে মামলা করতে। শ্বশুরবাড়িতে কী কী ধরনের অত্যাচার হয় সেগুলো উকিলকে বোঝাচ্ছে নিচু গলায়। উকিলই বেশি বেশি কথা বলছেন এবং মেয়েটি হ্যাঁ আর না তে উত্তর দিচ্ছে। বেচারা বাবা করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চান মেয়ের ভবিষ্যৎ যাতে ভালো হয়। এর বেশি কিছু তার চাইবার নেই। ছেলেটিও তখন কোর্টে হাজির। তার বয়স মনে হল কম করে হলেও চল্লিশ তো হবেই। মনে হল তাদের দুজনকে বোঝাবার জন্য উকিল সাহেব ডেকেছিলেন। উকিলবাবু খুব শান্ত স্বভাবের এবং তিনি খুব নিচু গলায় ধীরে ধীরে কথা বলেন।

উকিল (ছেলেটিকে) – আপনি কী চান ?

ছেলেটি – নিজের বউকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না।

উকিল (মেয়েটিকে) – আপনি কি ঘরে ফিরতে চান ?

মেয়েটি – না।

মেয়েটির বাবার তখন বুক দুরুদুরু। একবার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি ভাবছেন শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলে মেয়ের সংসারটা যদি বাঁচে। আবার জোর করে পাঠালে যদি মেয়ে কিছু করে বসে। এগোলেও মুশকিল, পেছোলেও মুশকিল।

উকিল (ছেলেটিকে) – ও তো যেতে চাইছে না।

ছেলেটি (উকিলকে) – ওকে আপনি বলুন যেতে। আর গণ্ডগোল হবে না।

উকিল (মেয়েটিকে) – কি যাবে ?

মেয়েটি – না। ও ওরকম বলে। এর আগে অনেকবার বলেছে। কিন্তু বাড়ির লোক অত্যাচার করে। ও

তাদের কিছু বলে না।

উকিল (ছেলেটিকে) – দেখুন কি বলছে। এর পরেও বলবেন ওকে যেতে ?

ছেলেটি – যদি আবার গণ্ডগোল হয় তবে তো। তখন আবার না হয় ও এখানে আসবে। আগে তো হতে

     দিন গণ্ডগোল।

     ছেলেটির এই কথাগুলো একটু নাটকীয় ভঙ্গিমায় শোনাচ্ছিল। উকিল বললেন, “ধুৎ। আপনার অ্যাটিটিউট ঠিক নেই। কিভাবে কথা বলছেন আপনি। ছেলেটি একটু থমকে গিয়ে বলল, “তাহলে আর কি বলবো বলুন। যা ভালো মনে হয় করুন”।

     এই বলে সবাই চুপ হয় গেল। মনে হচ্ছিল ঠাণ্ডা মাথার উকিলেরও একটু মাথা গরম হয়ে গেছিল। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে ছেলেটিকে বোঝাতে লাগলেন সংসারের অনেক অভিজ্ঞতা। কী করা উচিৎ, কী অনুচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। বললেন, “অতীত ভুলে যাও। নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। গোটা জীবন পড়ে আছে। আপনার বউয়ের সুরক্ষার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। আপনারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলুন। এখানে অথবা একটু দূরে গিয়ে”।

     বলতেই ছেলেটি একটু দূরে সরে গেল। আমি ভাবছিলাম এবার মেয়েটি কী করে দেখি। সে দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির পিছু ধরল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি তারা কথা বলছে একটু দূরে। আমি আর সেদিকে তাকাইনি। তবে এটুকু বুঝলাম যে মেয়েটির মনে ছেলেটির জন্য এখনো স্থান রয়েছে। মনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। নাহলে উকিল বলাতেই চট করে সে ওভাবে স্বামীর সাথে কথা বলতে যেত না।

     তার বাবা ছলছল চোখে আমাদের সামনেই ঘুরঘুর করছিলেন। উকিল এরপর অন্যদের নিয়ে অন্য কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। এসময় লক্ষ্য করলাম, একজন উকিল নয়। আরও দুজন উকিল আছেন। তারা যে যার নিজেদের প্রয়োজনে এদিকে আসছেন আবার চলে যাচ্ছেন। এজলাস অবশ্য একটাই। এতসব হচ্ছে কিন্তু আমার কেসটার কী অবস্থা সেটা বুঝতে পারছিনা। আমি কি এভাবে বসে বসে অন্যের কেস দেখতে এসেছি নাকি? সুনীলজীকে একটু তদ্বির করাতে তিনি বললেন লোক পাঠিয়েছেন, সে আসছে।

     সে এলো প্রায় তিনটের সময়। এই উকিলের একটা স্বভাব দেখেছি, কোনো একটা কাজ করতে করতে অন্য একজন এসে যেই ডাকছে, তিনি তার সাথে কথা বলতে লাগছেন। সে কথা আর শেষ হচ্ছেনা। ফলে কোনো কাজটাই সম্পূর্ণ হচ্ছেনা। আমার কাগজটা দু একবার উল্টে পালটে যেই না কিছু লেখতে যাবেন, অমনি কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। বাস, উনি তাকে নিয়ে পড়ে গেলেন।

     এদিকে সেই মেয়েটি আবার তার বাবার সাথে টেবিলের সামনে এসে হাজির। ছেলেটিকেও ডাকলেন উকিলবাবু। জিজ্ঞাসা করলেন যে তাহলে কি ঠিক করলেন বলুন। একসাথে থাকবেন নাকি আলাদা। মেয়েটি আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে। ছেলেটি বলল একসাথে থাকবো। উকিলবাবু বললেন, “বেশ ঠিক আছে। তবে এমন না হয় যে মেয়ের দিক থেকে কোনো অভিযোগ এলো। বাড়ির লোকরাও যেন বউকে অত্যাচার না করে সে দিকেও দেখতে হবে। নাহলে কিন্তু করতে সাজা অবধারিত”।

     এরপর ছেলেটি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটিকে উকিলবাবু বললেন, সংসারে অনেককিছু ঘটে। সবকিছু ধরলে চলেনা। মন দিয়ে ঘর করো। কিছু হলে কিছু উলটোপালটা সিদ্ধান্ত নিতে যেওনা। জীবন একটাই। ভগবানের দেওয়া জীবন এভাবে নষ্ট করতে নেই। (আমি বুঝলাম তারমানে মেয়েটি নির্ঘাত আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল)।

     মেয়েটি দোদুল্যমান অবস্থা থেকে বের হল। উকিলের কথায় সে বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে সে আবার সংসার করতে পারবে। এক ছুট্টে সে বরের কাছে চলে গিয়ে বরকে জড়িয়ে ধরল। তখন বরও কাঁদছে, বউও কাঁদছে। বাবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তিনি কাঁদতে ভুলে গেছেন। উকিলের মুখে মুচকি হাসি। সাফল্য তো তারই। আমার কিন্তু চোখে জল। ভাবছিলাম এটাই তো ভালো হলো। মেয়েটা যখন দৌড়ে বরের কাছে গেল, সেটা দেখার মতো। যেম আর তর সইছে না। যেন আর দেরি করলে যদি বর হাত ছাড়া হয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি পার তাকে আঁকড়ে ধরো। বরকে পেয়ে তাই এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। চোখের সামনে এভাবে একটা জীবন জোড়া লাগা দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। রইল আমার সাইকেল।

                        —–চলবে

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *