উধমপুরের উধমসাধু
উধমপুরের সাধুবাবা
২০২৪ সালের জুন মাসের ঘটনা। চলেছি মানালি থেকে লাদাখ। সেখান থেকে কাশ্মীর হয়ে জম্মু। পুরোটাই সাইকেলে। যাত্রার একেবারে শেষ দিকে এসে পৌঁছেছি। দু-দিন মাত্র বাকি। আজ আছি ‘পাট্নি টপ’এর কাছে ‘বাটোট্’ বলে একটি জায়গায় এক পূর্ব পরিচিত সর্দারজী’র বাড়ি। সেখান থেকে ৬ কিমি ওপরে উঠতে পারলেই পাট্নি টপ। তারপর শুধু নামা আর নামা। মাঝে একদিন থাকব উধমপুরে। তারপরের রাত জম্মু গেলেই আমার সাইকেল যাত্রা শেষ।
টোট্ থেকে উধমপুর মাত্র ৬০ কিমি, তা–ও আবার পাহাড় থেকে নামা। মাঝে কিছুটা মাত্র ওঠা আছে। হিসেব মতো খুব বেশি হলে ৩ ঘণ্টা লাগার কথা। অর্থাৎ আজকে আমার সুখের দিন। কোনো তাড়া নেই, পাট্নি টপে অনেক সময় নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। ঠিক নামতে যাব, হল বিপত্তি। রাস্তা সারাইয়ের একটি গাড়ি পাশের নর্দমায় পড়ে গেছে। তাকে তুলতে আর একটি গাড়ি এসেছে। সেটি তোলা না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ। এদিকে আমি ঘড়ি দেখছি ঘন ঘন। ভাবছি এতক্ষণ ওপরে বসে না থাকলেই ভাল হতো।
অন্ততঃ আলো থাকতে থাকতে উধমপুর পৌঁছনো উচিত। আগেরবার সেখানে একটি শিব মন্দিরে এক সাধুবাবার কাছে ছিলাম। এবার ইচ্ছে আছে ইস্কন মন্দিরে থাকার। সেবার দেখে বেশ ভাল লেগেছিল ইস্কন মন্দিরটা। অগত্যা থাকতে না পারলে শিব মন্দির তো আছে। অন্ধকার হয়ে গেলে কেউ সহজে জায়গা দিতে চায় না। বিকেল বিকেল পৌঁছলে তাদের হাতে সময় থাকে, ভালোভাবে নিজের পরিচয় দেওয়া যায়।
অগত্যা আমি গুটি গুটি পায়ে চললাম সেই শিব মন্দিরের দিকে। সেখানে রাত কাটানোই আমার ভাগ্যে লেখা আছে। রাত প্রায় আটটা বাজে। সাধুবাবার দরজার সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ ডাকলাম, কিন্তু তিনি নিদ্রা গেছেন। পাখাটা–ও এতো জোরে আওয়াজ করে ঘুরছে যে আমার শব্দ সাধুবাবার কান অবধি পৌঁছচ্ছে না। এবার আমার কী করণীয় বুঝতে পারছি না। খাবার দোকান সব বন্ধ। ফলে রাতে খাবার যে জুটবে না বুঝতেই পারছি।
শিবের মন্দিরের সামনে একটা চাতাল মতো আছে। পাশে আছে একটা কুন্ড, জল ভর্তি। কুন্ডের পাশে গিয়ে বসে রইলাম। মালপত্তরগুলো ইতস্ততঃ ছড়ানো। আর সাইকেলটা রেখেছি সাধুবাবার ঘরের পাশে। ওখানে একটা লোহার স্তম্ভ আছে, তাইতে বেঁধেছি সাইকেলটা। এখন আমার কাজ বলতে টেন্ট খাটানো এবং শুয়ে পড়া। কাল সকালে উঠে জম্মু যেতে হবে। তবে এভাবে কাউকে কিছু না বলে শুয়ে পড়ব? একবার অন্তত সাধুবাবাকে বলে শোয়া উচিত। নাহলে রাতে উনি অচেনা একজনের প্রবেশ দেখে ঘাবড়ে যেতে পারেন। রেগেও যেতে পারেন। এই সব ভাবছি আর ব্যাগে যত কাজু, কিসমিস, বিস্কুট ছিল বসে বসে খাচ্ছি।
এমন সময় হঠাৎ মনে হল সাধুবাবার দরজার কোনা দিয়ে এক ছিটে আলো। এতক্ষণ তো অন্ধকার দেখেছি, তারমানে নির্ঘাৎ সাধুবাবা উঠেছেন। এগিয়ে গিয়ে দেখি সাধুবাবা ঘরের পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক যেখানে আমার সাইকেলটা দাঁড় করানো। বুঝলাম উনি প্রস্রাব করছেন। আমি অপেক্ষা করছি। আলোর নিচে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছি যেন তিনি ঘরে ঢোকার মুখে আমাকে দেখতে পান। ওহ মা! দেখা তো দূরের কথা, একটা পাক মেরে কেমন যেন মাতালদের মতো টলতে টলতে সোজা তিনি ঘরে ঢুকে পড়লেন। চোখে ঘুম আছে বোধহয়। অথচ আমি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে, আমাকে না দেখার কথা নয়। আমি তাঁর কাছে এগোতে গিয়েও থমকে গেলাম, তাঁর গায়ে বস্ত্রের নামগন্ধ নেই। পুরোপুরি উলঙ্গ। এমত অবস্থায় কারো কাছে যাওয়া যায় নাকি?
তিনি ঘরে ঢুকে দিলেন দরজা বন্ধ করে। আমার আর তাঁকে ডাকার মানে হয় না। অগত্যা একটাই কাজ বাকি রইল, টেন্ট খাটিয়ে শুয়ে পড়া, রাতে কিছু হলে দেখা যাবে। এদিকে কুন্ডের কাছে ছোট বড় অসংখ্য শামুখ। ততক্ষণে কিছু কিছু ব্যাগের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। চট্ করে টেন্টটা খাটিয়ে ফেললাম। শুধু একটাই লক্ষ্য, যাতে টেন্টে শামুখ না ঢোকে। সব গুছিয়ে যেই শুয়েছি আর শুরু হল বৃষ্টি।
জলের স্রোত বইছে আর আমি ভাবছি টেন্টে না জল ঢুকে যায়। জম্মু সম্বন্ধে যাদের জ্ঞান আছে তারা জানে, এখানে বায়ুর আদ্রতা প্রচন্ড। টেন্টের ভেতরে থাকা যাচ্ছেনা। এই করে করে ঘুমটাই হল না। ঘড়িতে দেখি রাত তিনটে। ভাবলাম আর ঘুম হবেনা, টেন্ট ও মালপত্তর গুটিয়ে নিয়ে মানে মানে জম্মুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।
টেন্ট থেকে বেরিয়ে আকাশে আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করছি, সামনে হাঁটাহাঁটি করছি। সামনেই কল দিয়ে অনর্গল পাহাড় থেকে জল নেমে আসছে। কাছাকাছির মানুষজন এখানে স্নান করতে আসে। অনেক রাত অবধি লোক থাকে। আমিও কাল এখানেই রাতে স্নান করেছি। ভোর হতেই আবার একজন একজন করে লোক আসতে শুরু করে। তবে এখনও দেখছি কেউ আসেনি। আমি একাই ঘুরঘুর করছি। হঠাৎ আবার সাধুবাবার দেখা। একটু দূরে ছিলাম। সাধুবাবা সাইকেলের কাছেই দাঁড়িয়ে কী একটা করছেন। আমি ভাবলাম আবার বোধহয় প্রস্রাব করছেন। আর সুযোগ ছাড়ব না। ঘরে ঢোকার আগে এবার কথা বলতেই হবে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, তার আগেই সাধুবাবা ঘরে ঢুকে গেলেন। কাছে গিয়ে দেখি সাইকেলটা উলটো করে পড়ে রয়েছে। ফেলল টা কে! রাতে কি কেউ চুরি করতে এসেছিল? বলতে বলতেই সাধুবাবা আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাম হাতে তাঁর একটা বড় ছুরি। ডান হাতে একটা চেন কাটার যন্ত্র। আমি গিয়েছি ঘাবড়ে। এত দ্রুত উনি কাছে চলে এসেছেন যে আমি অত কিছু ভাবার সময় পাইনি। হাত জোড় করে তাঁকে বললাম, “বাবাজী, হামকো পয়েচান্তে হ্যায়”? হঠাৎ আমাকে দেখে তিনিও চমকে উঠেছেন। অত ভোরে উনি ভাবেননি যে কেউ উপস্থিত থাকতে পারে। চমকে উঠে বিশাল চিৎকার করে তিনি আমাকে বললেন, “কোন হ্যায় তু?” বলেই ছুরিটা আমার দিকে উঁচিয়ে ধরেছেন। আমি বুঝতেই পারছি হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে এবার তিনি হাত চালালেন বলে। অবলাদের মতো হাত জোড় করে তাঁর পায়ে পড়লাম। শুধু বলতে লাগলাম, “হুমকো আপ পহেচান্তে হ্যায় বাবাজী, হুমকো আপ পহেচান্তে হ্যায়। ম্যায় একবার আয়া থা আপকে পাশ”। তাঁর বোধহয় কিছুটা সম্বিত ফিরল। আর একবার চিৎকার করে বললেন, “তু ইধার আয়া ক্যায়েসে?”
এই ভোর–রাতে চারিদিক শুনশান। তাঁর চিৎকারের আওয়াজ বহুদূর পর্যন্ত যাচ্ছে। এখানের সমাজে এই সাধুবাবাদের প্রভাব বিশাল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষজন তাঁদের সম্মান করে। একটাই ভয় পাচ্ছি, যদি কোনো মানুষজন এসব দেখে ভাবে যে আমি সাধুবাবার ক্ষতি করতে এসেছি, তাহলে তো কথাই নেই। কোনো কথা না শুনে তারা আমাকে মারতে শুরু করবে। গণপ্রহার, মেরেও ফেলতে পারে। কোনো সময় নষ্ট না করে শুধু একটি কথাই আমার মুখ দিয়ে বের হল, “হামকো পাঁচ মিনিট টাইম দিজিয়ে”। বলেই আমি টেন্টের দিকে চলে গেলাম। উনি দেখলাম ঘরে ঢুকে গেলেন। বুঝলাম হাতে অন্ততঃ পাঁচ মিনিট সময় আছে। জানিনা কীভাবে অত তাড়াতাড়ি অত কিছু করলাম। প্রথমেই সাইকেলটা রাস্তায় রেখে আসলাম। একটা সরু খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে দেড় তোলা উঁচু রাস্তায় সাইকেলটা কাঁধে করে তোলা বেশ কষ্টকর। তারপর টেন্টটা কোনোক্রমে গুটিয়ে বাকি জিনিসপত্তর হাতে নিয়ে দু-তিন বারের চেষ্টায় সাইকেলের কাছে সবকিছু রাখতে সক্ষম হলাম। তখনো জামাকাপড় ভাল করে পড়া নেই, জুতো পায়ে গলানো হয়নি, ব্যাগ গুছানো হয়নি। তবু ভাবলাম, এই ঝঞ্ঝাটের জায়গা ছেড়ে একটু এগিয়ে যাওয়াই মঙ্গল।
কিছুটা কাঁধে, কিছুটা হাতে, কিছুটা সাইকেলে, এভাবে জিনিসপত্র নিয়ে মূল সড়কে এসে দাঁড়ালাম। তারপর সাইকেল চালাবার জামাকাপড় পড়লাম। সাইকেলে ব্যাগপত্তর বাঁধলাম। আকাশে হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। একটা জোরে দম নিলাম আর ভাবতে শুরু করলাম ঘটে যাওয়া কান্ডকলাপ। ঘুরে ফিরে একটা কথাই বারবার মনে আসতে লাগলো, মাঝরাতে যদি সাধুবাবা দেখতেন একটা টেন্ট খাটিয়ে কেউ শুয়ে আছে তাহলে তিনি কী রূপটি দেখাতেন! যিনি কাটার নিয়ে সাইকেলের চেন কেটে সেটিকে ফেলতে উদ্যত হন, তিনি নিশ্চিতভাবে আমার টেন্টটি ছুরি দিয়ে কেটে দিতেন। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি এটা আমার পরে মনে হয়েছে, উনি ছুরি আর কাটার দিয়ে সাইকেলের চেনটা কেটে সাইকেলটাকে পাশের নদীতে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন।
চলার পথে অজানা অচেনা ঘটনার সম্মুখীন হবার প্রস্তুতি থাকে। বিপদজনক কিছু ঘটে গেলে তাঁর থেকে উদ্ধার পেয়ে ফিরে এলে অনেক মানুষজন আসে সে গল্প শুনতে। যাত্রাপথের বিপদগুলো তখন যাত্রার গল্পগুলোকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু আমরা গল্প শোনানোর জন্য এ বিপদকে আহ্বান করিনা। যাবার আগে ভাবতেও চাইনা কোনো বাজে ঘটনা ঘটুক।। কিন্তু কিছু না কিছু ঘটে। সব ঘটনার চরিত্র সবার থেকে আলাদা। তা’বলে তো পথ চলা থামতে পারে না। তাহলে তো জীবনই থেমে যাবে।