জোজিলার কালো রাত

সে একরাত বটে। রোদ ঝলমলে সকালে টেন্টের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি চারিধারের পাহাড়ের মাথায় সোনালী সূর্যের ছটা। সোনামার্গের যাত্রীনিবাসে মনোরম ঘাসের ওপর টেন্ট খাটিয়েছিলাম। সাইকেল চালিয়ে চলেছি লাদাখ। সোনামার্গের পরে বড় শহর হল দ্রাস। পথে আছে ‘জোজিলা পাস’ (৩৫২৮ মি. উঁচু)। এর আগে পাসের প্রকৃতি সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা ছিল না। শুধু জানতাম একটা পাহাড় টপকে পরের পাহাড়ে যেতে গেলে একটা উঁচু অংশ পেরোতে হয়।

জোজিলা পাসের ছবি দেখে মনে হয়েছিল ওরেবাবা! চালানো সম্ভব নয়। হেঁটে উঠতে হবে। তবে উঠতে উঠতে প্রায় ৩৫০০মি. উচ্চতায় আমার ফুসফুসের কতটা দফারফা হবে সেটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। কারণ আমি COPD রোগগ্রস্থ। পাসের রাস্তাগুলো খুব চড়াই ও দীর্ঘ হয়। তাই ঠিক করেছিলাম পাস যেখান থেকে শুরু হচ্ছে ঠিক তার আগের কোনো একটি গ্রামে রাত্রিবাস করব। যাতে পরেরদিন পূর্ণশক্তি নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারি। সেই মতো ঠিক ছিল বালতালে রাত্রিবাস করব। শ্রীনগর থেকে বালতাল পৌঁছতে পারিনি যে কোনো কারণেই হোক। তাই সোনামার্গে রাত্রিবাস করতে হয়েছিল।

সোনামার্গের সেই শুভ্র সকালে শরীরে ও মনে এমন সতেজতা এল যে মনে হল আজই দ্রাস পৌঁছে যাব। অতএব আজই আমাকে জোজিলা পাস অতিক্রম করতে হবে। সামান্য উঁচু নিচু রাস্তা পেরোতে পেরোতে নিমেষে বালতাল পৌঁছে গেলাম। সেখানে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা চলে গেছে সোজা জোজিলা পাসে। একটা ডানদিকে বালতাল মিলিটারী বেস ক্যাম্পের দিকে। লরি বা অনান্য গাড়ী যেগুলো লাদাখ যাবে, সোজা চলে যাচ্ছে। দুটো পাক মেরে যে উচ্চতায় উঠছে তা ঘাড় তুলে দেখতে হচ্ছে। আমি ভাবছি পাসের শুরুতেই এই উঁচু রাস্তা। যত সময় যাবে আরো কত উঠতে হবে কে জানে। তবে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি সে ধাক্কা সামলাবার জন্য। একটা অসুবিধা হল যে আজ দেরী করে (দুপুর ২’টোর সময়) চালাতে শুরু করেছি। শরীরকে একটু বিশ্রাম দিতে হয়েছিল। আগের দিন আসার সময় শরীরে একটু চাপ পড়ে গিয়েছিল। তাই বালতাল পৌঁছতে পৌঁছতেই বিকেল ৩.৩০ বেজে গেল।

ডানদিকের রাস্তাটা কোথায় গেছে জিজ্ঞসা করাতে একজন বলল বালতাল বেসক্যাম্প। অমরনাথ গুহা দর্শনের রাস্তা। তবে এ পথেও জোজিলা যাওয়া যায়। এ পথটা ওতটা উঁচু নয়। এটা জানতে পেরে স্বাভাবিকভাবেই আমি এ পথেই অগ্রসর হলাম। বেশ দশ কিমি মতোএগিয়ে গিয়ে একটা মোড় এল। বাঁ দিকে একটা সংযোগকারী রাস্তা জোজিলার রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। এ জন্য আমাকে দু এক কিমি পেছিয়ে আসতে হল। পুরো রাস্তাটাই উঁচু, ফলে হেঁটে উঠলাম। উঁচু হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ কোথাও না কোথাও তো জোজিলার উঁচু রাস্তা ধরতে গেলে উঠতেই হবে।

সেই রাস্তায় পৌঁছে একটা দোকান পেলাম। শুনলাম এটাই শেষ দোকান। অতএব যা কিছু খাবার এখানেই খেতে হবে। চা, বিস্কুট খাচ্ছি এমন সময় একজন হাঁক দিল “অমরনাথজী দর্শন করেছেন”?এখানে বাংলা শুনে চমকে উঠে দেখি এক সাধুবাবা। অমরনাথ দর্শন করে মানালির আশ্রমে ফিরে যাচ্ছেন। অপেক্ষা করছেন যদি কোনো লরি বা কেউ তাকে নিয়ে যায়। এক J&K পুলিস আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথায় যেতে চাইছি। দ্রাস যাব শুনে বললেন, “আপনাকে জোজিলা পার হতে হবে। কত উঁচু ধারণা আছে”? ধারণা না থাকার এই একটা সুবিধে। না বুঝেই বলে দিলাম, যত উঁচু হোক যাব। দরকার হলে পুরোটাই হেঁটে হেঁটে যাব। তিনি বললেন এখনি তো বিকেল হতে চলল। জোজিলা পার করে অন্তত জিরো পয়েন্ট না যেতে পারলে থাকার জায়গা পাবেন না। আমি বললাম আমার কোনো চাপ নেই। কারণ সঙ্গে টেন্ট আছে। তিনি বললেন তাহলে ঠিক আছে। রাস্তায় অন্য কোনো ভয় নেই। তবে ভাল্লুক থেকে সাবধান।

আমি তখন যাবার নেশায় মগ্ন। ফলে কানে কিছুই ঢুকল না। মনের জোরের কাছে অনেক কিছুই হার মানে। যত ওপরে উঠছি, সিন্দ নদীর তীরে বেসক্যাম্প ক্রমশ ছোট হচ্ছে। তার ধার বরাবর অসংখ্য তাঁবু অমরনাথ যাত্রীদের জন্য। একসময় নদীটা ডানদিকে চলে গেল। সঙ্গে রাস্তা ও বসতিগুলোও তার সাথে ডানদিকে হারিয়ে গেল। ওটাই অমরনাথ যাবার রাস্তা। বরফে মোড়া পাহাড়ী চুড়াগুলো দেখে আন্দাজ করতে লাগলাম কোনটা অমরনাথ হতে পারে।

উঠতে উঠতে পাহাড়ের প্যাঁচগুলো দেখছি আর ছবির সাথে মেলাচ্ছি কতটা চেনা লাগছে। ছবি দেখে ভেবেছিলাম এ তো অসম্ভব। তার ওপর ভারী সাইকেল। কিন্তু আজ আমি সেখানেই হাজির। ভাবছি, এই তো পারছি। আসলে আগে থেকে কষ্টকে নিয়ে বেশি ভাবলে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। তাকে জয় করা যায় না। উঁচুর দিকে না তাকিয়ে (তাতে মানসিক জোর কমে যায়) মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে চলাই শ্রেয় মনে করলাম। বারবার দম নিতে হচ্ছে। দু পা বাড়ালেই দমে ঘাটতি হচ্ছে। একটু দাঁড়ালেই আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কত আর দাঁড়াব। প্রচুর জল খাচ্ছি, জলই বা কত খাব। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে। আকাশে আলো কমে আসছে। এক কোনে একটু কালো মেঘের আনাগোনা। এই প্রতিকূল পরিবেশে বৃষ্টি নামলে আর রক্ষে নেই। কোথাও কোনো আচ্ছাদনের লেশ মাত্র নেই। বালতাল বেস ক্যাম্পের দিকে যা কিছু সবুজ ছিল ছাড়িয়ে চলে এসেছি। আমার পথে এখন নেড়া পাহাড় বাড়ছে। সোনামার্গে কাল রাতে বেশ ঠাণ্ডা লেগেছিল। এখানে না জানি ঠাণ্ডায় কতটা জুজতে পারব। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি।

একটা পয়েন্টে গিয়ে রাস্তাটা দুভাগ হয়েছিল, আমি চলেছি শর্ট রাস্তাটা দিয়ে। এটা প্রায় তিন কিমি কম। এই উচ্চতায় তিন কিমি মানে বিরাট ব্যাপার। মূল যে রাস্তাটি, সেটি আরো উঁচু দিয়ে ঘুরে ঘুরে গেছে। একটা সময় সেটি কাছাকাছি আসতে শুরু করল। আমার মন বলল ওটাকে ধরতে পারলে জানব লক্ষ্যে পৌঁছতে আর বেশি দেরী নেই। একজন ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম জোজিলা মাত্র আধ কিমি বাকি। মনে একটা দম পেয়ে গেলাম। এটাই হয়। সবটাই Mind Set। গন্তব্যকে চোখে দেখতে পেলে মনে জোর আসে।

কিছুটা এগিয়ে একটা স্মারক দেখতে পেলাম। এই স্থানে এক সেনা অফিসারের মৃত্যুকে স্মরণ করে একটি সিমেন্টের চাতালের ওপর এটি বানানো। মাথায় একটা ছোট্ট ছাউনি। আরো কিছুটা উঠে ওপরের রাস্তার সাথে যেখানে মিশলাম, সেখানে একটা হতাশা এল। আসলে শরীরটা ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছিল। মনের জোরে চলছিলাম। কিন্তু এখানে এসে মনে হল জোজিলা টপ এটা নয়, আরো দূরে। আমার একটা ধারণা ছিল যে রাস্তার ওপরে হয়তো কোনো সিকিউরিটি চেকিং থাকবে অথবা রাস্তার ধারে কোনো ফলকে উচ্চতা লেখা থাকবে। সেসব দেখতে পেলাম না। রাস্তাটাও যে নামছে তা নয়। বরং কিছুটা ওঠার মতোই লাগছে। পরে জেনেছি ওটাই নাকি জোজিলা টপ। তখন জানলে মনের জোর পেয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এগিয়ে যেতাম। Mind Game এ পরাজিত হয়ে ঠিক করলাম সামান্য নীচে ওই মেমোরিয়ালের চাতালে রাত কাটাবো। বড়জোড় একশ মিটার হবে। নামার আগে নিজেকে বোঝালাম, নামছি, এটা সাময়িক পরাজয়। তবে জয় করতে গেলে সাময়িক পরাজয় বরণ করতে হয় আরো বড় পদক্ষেপের জন্য। ফিরে এলাম সেখানে। সমস্যা হল না আছে খাবার না আছে জল। নিরুপায় হয়ে একটা গাড়ীকে দাঁড় করিয়ে একটু জল চাইলাম। গাড়ীটা দ্রাসের দিক থেকে শ্রীনগর যাচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল এখানে কী করছেন? আমি বললাম টেন্ট খাটাবো। আর পারছিনা যেতে। সে বলল এখানে ভাল্লুক আছে, আলো জ্বাললে  দেখে ফেলবে, আক্রমন করবে। এখানে না থাকাই ভালো। চলে যান জিরো পয়েন্ট। এটা বলে সে চলে গেল।

তখন আকাশ একেবারে অন্ধকার। রাত ৮-৩০বেজে গেছে। শরীরের যা অবস্থা, আর যাওয়া অসম্ভব। আর কারো এ রকম হয়েছে কিনা জানিনা, এই প্রথম প্রাণের ভয়ের কাছে আমার শরীর হার মানল। উপলব্ধি করতে লাগলাম সেই সব অক্ষম মানুষদের কথা, মৃত্যুর থাবা যাদের দিকে এগিয়ে এলেও তাদের কিছু করার থাকে না। নিঃশব্দে তা বরণ করতে হয়। ঠিক করলাম ভাল্লুক খায় খাবে, কিছু করার নেই। এখানেই থাকব। আসলে বিপদের যে সম্মুখীন হয়নি, বিপদের চরিত্র সে আঁচ করতে পারেনা।

পাহাড়ের ঢালগুলো অন্ধকারেই দেখছি কাছাকাছি ভাল্লুক আছে কিনা। অক্ষমের বৃথা চেষ্টা। যেন তারা আমাকে দর্শন দেবার জন্য কাছাকাছি বসে আছে। সারারাত ধরে যারা মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারে, তারা এখন কাছাকাছি আছে কিনা তা দেখা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। সাইকেল থেকে বাঁধন খুলতে শুরু করলাম। সোলার প্যানেলটা খুলে চাতালে রেখেছি। টেন্ট নামিয়েছি খাটাবো বলে। প্রচণ্ড হাওয়া চলছে। যাতে টেন্ট ঊড়ে না যায় সেটাও ভাবাচ্ছে। এসময় একটা গাড়ীকে ওপরে আসতে দেখলাম। সব গাড়ী এ সময় নিচের দিকেই নামে। হাতে গোনা দু একটা গাড়ী ওপরে যায়। গাড়ীটার সামনে গিয়ে হাত দেখিয়ে দাঁড় করালাম। তাকে জিজ্ঞাসা করালাম, “এখানে রাতে থাকবো ঠিক করেছি, শুনলাম এখানে ভাল্লুক আছে। সেটা কি সত্যি”? সে বলল, “অবশ্যই”। এখানে আমরা দিনের বেলায় ভাল্লুক দেখি, রাতের তো কথাই নেই। এখনো হয়ত কোনো ভাল্লুক কাছাকাছি আছে, বুঝতে পারছি না। এখানে দাঁড়ানো আমার ঠিক হচ্ছে না। আপনি থাকলে বিপদ অনিবার্য। এখুনি চলে যান। রাতে জোজিলা পাস দ্রাসের দিক থেকে বন্ধ থাকে। জিরো পয়েন্টে সিকিউরিটি গেট বন্ধ থাকে। তাই এখন এটা ওদের স্বর্গরাজ্য।

আমার প্রাণে বেশ ভয় ঢুকল। বুঝলাম মৃত্যু কে সঙ্গে করে এখানে থাকতে চলেছি। তাকে বললাম আমায় বাঁচাও ভাই। তোমার গাড়ীতে করে অন্তত জিরো পয়েন্ট অবধি পৌঁছে দাও। সে বলল এটা একটা সবজি গাড়ী। পেছনে কিছু তোলা যাবে না। মালপত্তর সব গাড়ীর কেবিনের ছাদে তুলতে হবে। আমি সবেতেই রাজি, তবে বিপদ বুঝে সেই প্রায় সব কাজ নিজেই করল। কারণ দাঁড়ালে তারও ভয় লাগছিল। সব মালপত্তর টেনে সে কেবিনে তুলল। সাইকেলটাকে দড়ি দিয়ে কষে গাড়ীর পেছনের ডালায় বাঁধল। আমাকে বলল কেবিনে গিয়ে বসতে। অন্ধকারে আমিও দেখলাম না কী মাল উঠল আর কী উঠল না।

গাড়ী চলতে শুরু হল আসতে আসতে কারণ রাস্তা মোটে ভালো ছিল না। ঝুলন্ত সাইকেলটা দুলছে আর খটাং খটাং করে আওয়াজ হচ্ছে। ভাবছি এই বুঝি খুলে গেল। মাঝে একবার গাড়ী থামিয়ে দেখতে হল যে সাইকেল যথাস্থানে আছে কিনা।

এরপর একটু হাঁফ ছাড়লাম, স্বস্থি পেলাম। ড্রাইভারের সাথে পরিচয় করতে শুরু করলাম। এতক্ষণ সেও কোনো কথা বলার সুযোগ পায়নি। তার নাম ‘মজফ্‌ফর আহমেদ’। বাড়ি শ্রীনগরে Ganderbal এর Wayil’এ। দ্রাস কার্গিলে চাষ আবাদের সুযোগ কম। যা কিছু সবুজ সবজি তা মূলত কাশ্মীর থেকেই আসে। মজফ্‌ফর গাড়ী করে সপ্তাহে অন্তত দু-তিনদিন সবজি নিয়ে আসে। তার নিজের গাড়ী আছে। দিনের বেলা এ অঞ্চলে সে অনেকবার ভাল্লুক দেখেছে। বড় বড় ভাল্লুক। তারা গাড়ীতে এসে ধাক্কা মারে। মানুষ পেলে তো কথাই নেই। আমি বললাম আমার খাবার গন্ধ নির্ঘাত ওরা পেত। ও বলল খাবার নয়, আপনার শরীরের গন্ধ পেয়ে ওরা চলে আসত। পাহাড়ের গায়ে অনেক গৃহপালিত ভেড়া, ছাগল চড়ে। তারা মূলত সেগুলোর সন্ধানেই আসে।

জিরো পয়েন্টে এসে মজফ্‌ফর গাড়ী দাঁড় করাল। বলল চা খাবে। ওরও খুব কসরত হয়েছে বেচারা। আমি বললাম শুধু চা কেন, তোমার যা ইচ্ছে খাও। আমি খাওয়াব। ও শুধু চা’ই খেল। বলল আপনি বরং খেয়ে নিন পেট পুরে। এরপর আর খাবার পাবেন না। কোথায় থাকবেন ঠিক করুন। আমি বললাম তুমি কতদূর যাবে, উত্তর দিল দ্রাস। আমার আজ দ্রাস পর্যন্তই যাবার কথা। তাকে বললাম তুমি আমাকে যখন রক্ষা করেছ, এত রাতে আমি তোমাকে আর ছাড়তে চাইছি না। ওর সাথে বেশ একটা একাত্মতা অনুভব করছিলাম। এখানে তো থাকার জায়গা বলে কিছু নেই। আমাকে টেন্ট খাটাতে হবে। দ্রাসে হোটেল পাব। একটু বিশ্রাম নিতে পারব। তুমি বরং আমায় দ্রাস অবধি পৌঁছে দাও।

সে সানন্দে রাজি হল। এটা ছিল তার শালার দোকান। শালার নাম ফারুক। এখানেই দোকান চালান যতদিন রাস্তা খোলা থাকে। শীতকালে এখানে প্রচুর বরফ পড়ে। রাস্তা প্রায় (৪-৫) ফুট বরফে ঢেকে যায়। তখন জোজিলা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি সোনামার্গে ঘরে ফিরে যান। দুটো ডিমের অমলেট, পাউরুটি আর চা খেতে খেতে তাদের শালা ভগ্নিপোতের গল্প শুনছিলাম। তারা উর্দু ভাষায় আমাকে নিয়েই আলোচনা করছিল। সব শুনে শালাবাবু আমাকে বললেন, “খুব জোর বেঁচে গেছেন। আপনি যে রাস্তায় এসেছেন কোনো গ্রাম নেই, যা আছে এখানের পর থেকে। ওই অঞ্চলে ভাল্লুক এবং অজানা জন্তুও চলাচল করে। দিনের বেলাতেও এসে পড়ে। এভাবে না জেনে কাজ করবেন না”।  আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না যে J &K পুলিশের একজন আমাকে বলেছিল যেখানে খুশি সেখানে টেন্ট খাটাতে পারেন। তবে তিনি হয়ত জোজিলার পরের অংশে টেন্টের কথা ভেবেছিলেন, আমি বুঝিনি।

জোজিলা থেকে নেমে একটা নদীর ধার বরাবর চলতে লাগলাম। গুমরি নদী। নদীর নামেই গ্রামের নাম গুমরি। তার কিছুটা পরেই আলো ঝলমলে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। জোজিলা ট্যানেলের পূর্ব প্রান্ত। এখানে কাজ চলছে জোজিলা টানেলের। জোজিলা ট্যানেল হল পাহাড়ের ভেতরে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গপথ যার শ্রীনগরে পশ্চিমপ্রান্ত। সেখান দিয়ে ঢুকে এই পূর্ব প্রান্তে খুব সহজে পৌঁছনো যাবে। জোজিলার এই প্রতিকুল পরিবেশকে আর মোকাবিলা করতে হবে না।

রাত দশটায় দ্রাসে ঢুকলাম। হোটেল সব বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার তো দুরের কথা, শুতে পর্যন্ত কেঊ দিল না। অথচ তাদের গেট খোলা। কী নিয়ম তাদের জানিনা। শেষ ঊপায় ছিল দ্রাসের BRO বাহিনীর (55RCC GREF) আশ্রয় নেওয়া। গেটের বাইরে থেকে অনেক অনুরোধ করলাম। বৃথা চেষ্টা। কাছেই একটা মসজিদে গেলাম। পবিত্র এই স্থানে তারা শোবার অনুমতি দিলেন না। এদিকে মজফ্‌ফরেরও দেরী হয়ে যাচ্ছে। সে কাল সকাল সকাল উঠবে। কিন্তু আমাকে ঝেড়ে ফেলতেও পারছে না। আমি বললাম টেন্ট খাটিয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ছি। সে তাতে রাজি হল না। কারণ এখানের রাস্তাও ভাল্লুকের হাত থেকে নিরাপদ নয়। তিনদিন আগেই নাকি রাতে প্রচুর কুকুর মাঝরাতে হঠাৎ চেঁচাতে শুরু করল। সে গাড়ীতেই শোয়। ঘুম ভেঙ্গে যেতে মাথা উঁচু করে গাড়ীর সামনের কাঁচ দিয়ে চেষ্টা করছে দেখার। যদিও চোখের সামনে কিছু পড়েনি। তবুও সাবধানের মান নেই। এই নির্জন রাস্তাতেও মাঝে মাঝে ভাল্লুক এসে পড়ে। আমি বললাম এ তো মহা মুশকিল। ভাল্লুক নেই কোথায় বলতে পারো? সারা রাস্তার কোথাও’ই তো তাহলে আমি টেন্ট খাটাতে পারবো না। সে অভয় দিয়ে বলল এই শেষ। দ্রাসের পর আর ভাল্লুকের উপদ্রপ নেই কারণ এরপর সবই নেড়া পাহাড়। তাদের বসবাসের উপযোগী জায়গা আর নেই।

IMG_20220701_062631

তাহলে কী করণীয়। সে আবার পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিল। বলল, “আপনি আমার গাড়ীর ছাদে শুতে পারবেন? আপনি লম্বা মানুষ। ওইটুকু তো জায়গা”। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলাম। কারণ একদম খোলা আকাশে এর আগে কখনো শুইনি। মুখে বললাম, “নো প্রবলেম”। সে তড়াক করে গাড়ীর ছাদে উঠে গেল। আমি তুলে দিতে একটা একটা করে সব মালপত্তর সে ছাদে রাখতে লাগল। আমি ঊঠে দেখি শোবার জায়গাটা লোহার Square Bar এর খাঁচা দিয়ে বানানো। তার ওপর শুতে হবে। যতটা সম্ভব মজফ্‌ফর ভাই আমার ম্যাট, টেন্টের কভার, চাদর এসব বিছিয়ে জায়গাটাকে শোবার উপযোগী করতে চেষ্টা করল। আমি বললাম, “এবার তুমি শুয়ে পড়। অনেক করেছ আমার জন্য। আমার নিজের পরিবারের কেউও এতটা করবে না”। সে নেমে গেল। দু মিনিট পর দেখি সে নিজের কম্বলটা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে বলল। আমি বললাম তোমার তো ঠাণ্ডা লাগবে। সে বলল, “আপনি খালি আকাশে শোবেন। আমি তো তাও কেবিনের ভেতর। আমার চেয়ে ওটা আপনার বেশি দরকার। শুয়ে পড়ুন। যদি দেখেন রাতে কুকুর চেঁচাচ্ছে, মাথা তুলে নড়াচড়া করবেন না”।

এই কথা শুনে কার আর ঘুম আসে। ওইটুকু জায়গায় মালপত্তরগুলোকে যথা সম্ভব গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম। পা’টা বাঁশের মতো বেরিয়ে রইল। এপাশ ওপাশ ফিরলেই লোহার রড বুকে ফুটছে। কিন্তু আমার সবই অভ্যাস আছে। কাটিয়ে দিলাম রাতটা। শুধু ভাবতে লাগলাম ভগবান আমায় কত আশীর্বাদ করেছে যে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও বিভিন্ন প্রকারের মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারছি। তাদের দর্শনে আমার জীবন দর্শনও পরিবর্তিত হচ্ছে। জীবনের মানে উপলব্ধি করতে পারছি। জীবনে চলার পথে বহুবার আমি ভগবানের দর্শন পেয়েছি। এরাই তো ভগবান। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে দিয়েছেন। যার যখন প্রয়োজন, এরা তাদের কাছে আবির্ভূত হচ্ছেন। আমার অভিজ্ঞতায় জেনেছি পৃথিবীতে ভালো লোকের চেয়ে বাজে লোকের সংখ্যা নগন্য। তাই পৃথিবীটা বেঁচে আছে।