আজ সম্পূর্ণ লকডাউন। সে দিনও তাই ছিল।গোড়া থেকেই বলি। ১৯৫৭ সালের ১লা এপ্রিল। এপ্রিল ফুলের দিন তার জন্ম। আবার সেই দিনই নয়া পয়সা (খুচরো এক-দুই-তিন-পাঁচ এইরকম পয়সাকে নয়া পয়সা বলা হত) চালু হয়েছিল। তাই তার ‘ন’-কাকা তাকে নয়া পয়সা বলেই ডাকতেন। এ’হেন মিলন প্রথম কথা শিখেছিল একটু দেরিতে। তার প্রথম মুখনিঃসৃত শব্দ ছিল “অ্যাগু বোদে গুগু বোদে”। (শব্দটা সামান্য রুপান্তরিত)। তাতেই বোঝা গেছিল সাধারণের চেয়ে সে বোধ হয় একটু
আলাদা হতে চলেছে। হাভে ভাবেও বোঝা যেত সেটা। এরপর স্কুলে ভর্তি হল। রোজ স্কুলে গেলেও কোনো দিনই সে নিজের ক্লাসে বসেনি। অন্য ক্লাসে গিয়ে বসত। এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ তার বাবাকে শুনতে হত। শেষমেশ একদিন সে মাস্টার মশাই এর কাছে বিড়ি চেয়ে বসল। সেটাই ছিল তার স্কুল জীবনের শেষ দিন।
মিলনও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। স্কুলটাও রক্ষা পেল বিশৃঙ্খলার হাত থেকে।
আরো ছোট বয়সে যথা সময়ে তার অন্নপ্রাশনের দিন আয়োজন সব সম্পূর্ণ। নিমন্ত্রন সম্পূর্ণ। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এসেও গেছে। পূজোয় বসার কিছু পূর্বেই তার সেজ দাদু হঠাৎ মারা গেলেন। হার্ট অ্যাটাক। মৃত দেহ গেল শ্মশানে। এদিকে মাছ বিলি হল পাড়ায়, মিস্টি রইল বাড়িতেই। একসপ্তাহ ধরে যে যত পারল মিস্টি খেল। মিলন কিছুই জানল না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীর বাড়লেও তার বুদ্ধির বিকাশ হল না। একটা বড় মানুষ বাচ্ছাদের মতো ব্যবহার করলে সমাজের কাছে সে একটা মজার পাত্র হয়ে ওঠে। মিলনেরও সেই দশাই হল। তার জীবন বর্ণময় কিন্তু সামান্য পরিসরে কী ভাবে তা বলা সম্ভব। তবুও যতটা মনে পড়ে – বিভিন্ন রকম বদ অভ্যাস ছিল তার।
যেমন দিনের নির্দিষ্ট সময়ে সে বিড়ি খেত। তার আগেও নয়, পরেও নয়। সেটা আবার নির্ভর করত কলের জল আসার সময়ের ওপর। মিউনিসিপ্যালিটির জল আসত সকাল ৬টা, দুপুর ১২টা ও বিকেল ৪টে’তে। মিলন ঠিক এই সময়গুলোতে কলটা একবার খুলেই (যেই কলের জল পড়তে শুরু করত) বন্ধ করে ‘৬টা, ১২টা, ৪টে’ এইভাবে হাঁকত। সবাই জানত জল এসেছে। তারপরেই সে একটি নিদিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসত। কলের পাশেই ছিল ফুলতলার মাঠ। ঘাসে ভর্তি থাকলেও গোলপোস্টের পাশে এক ফুট ব্যাসের একটি জায়গায় ঘাস জন্মাবার সুযোগ পায়নি। মিলন সেখানে বসত বলে আর কারোর সেখানে বসার অধিকার ছিল না। এই তিনটি সময় তিনটি বিড়ি খেত এবং পাশেই ধীরা কাকিমার থেকে এক গ্লাস জল
খেয়ে অন্য কাজে যেত। যতক্ষন না কাকিমা জল দিত, সে যাবে না।
দিনে দিনে মিলনের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। বহুদূরে এসেও কেউ যদি মিলনের বাড়ি যেতে চাইত সবাই এক কথায় দেখিয়ে দিত। প্রতিদিন দুপুরে সে দুই শালিক না দেখে বাড়ি আসত না। পাড়ার কিছু ছেলের কাজই ছিল সে সময় হাজির হয়ে একটা শালিককে উড়িয়ে দেওয়া। মিলন তাদের বদমাইশি
ধরতে পারত না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও দুই শালিক আর আসে না। শেষে তার বাবা মিলনকে ডাকতে আসতেন। বুঝতে পারতেন ছেলেগুলো বদমাইশি করেছে। তিনি দাঁড়ালে ছেলেগুলো পালাতো। কিছুক্ষণের মধ্যে দুই শালিকের দেখা মিলত। তখন একটি নির্দিষ্ট সুরে দুটি শালিককে সে ‘দু শালিক – দু শালিক – দু শালিক’ এইভাবে ডাকত। তারপর নমস্কার করে বাড়ি যেত। আসলে ওখানে তেঁতুল গাছে শালিকের বাসা ছিল।
সরলতার জন্য মিলন সবার কাছে প্রিয় ছিল। কোনো নেমন্তন্ন বাড়ি বাদ যেত না। সব জায়গায় সে খেতে যেত। সবাই চিনত বলে প্রথম ব্যাচেই তাকে খাইয়ে দিত। না খেতে দিলে বিপদ। শেষ ব্যাচ অবধি অপেক্ষা করবে। বাড়ি ফিরতে রাত হলে বাড়ির লোকজন চিন্তায় পড়ত। তখন তার কাকা সানাই’এর আওয়াজ অথবা মাইকের গান বাজচ্ছে তার আওয়াজ ধরে ধরে সেই অনুষ্ঠান বাড়ি গিয়ে দেখত সেখানে ব্যাটা ঠিক বসে আছে। পাড়ার একজনের বিয়ে। বাসে করে সবাই বর যাত্রী যাবে। মিলন ধরেছে সেও যাবে যেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মিলন যাতে বাসে উঠতে না পারে সেটা দেখার। বাসের গেট আগলে সে দাঁড়িয়ে আছে। শীতের সন্ধ্যে। ঠিক সময়ে বাস ছাড়ল। দিল্লী রোড দিয়ে হু হু করে বাস ছুটছে। পেছনের গাড়ির আলো এসে পড়ছে বাসের পেছনের কাঁচে। হঠাৎ দেখা গেল, একটি ছায়ামূর্তি বাসের পেছনে দাঁড়িয়ে। গয়নাগাটি পরে আছে মহিলারা। ডাকাত পড়েছে ভেবে বাস গিয়ে দাঁড়াল পুলিশ স্টেশনে। পেছন
থেকে দেখা গেল মিলন নামল। সবাই বলল তুই পেছনে কেন? মিলন বলল- কী করব শালা, বড্ড শীত করছিল। তাই দাঁড়িয়ে পড়েছি”। এরপর বাসের ভেতরেই তার ঠাঁই হল। তার একটা স্টাইল ছিল নিজস্ব নামে পরিবারের লোকদের ডাকা। বাবা – পাবলে, মা – গামল, ভাইদের নাম ছিল – পাঁঠা লিলিসোনা, কামচিন ইত্যাদি ইত্যাদি। বোনেদের নাম ছিল – গিনিগিনিটা, মিনিমিনিটা ইত্যাদি ইত্যাদি। জ্যাঠা কাকাদের নাম ছিল – জেলুম, পিড়িং, নদু, হাগা, ইন্দিরা গান্ধী ইত্যাদি ইত্যাদি। জ্যেঠিমা কাকিমা দের নাম ছিল – পদু, খ্যাংড়াকাঠি আলুরদম, বুলবুলি পাখি ইত্যাদি। এছাড়াও লাংকি, ধিংগি, পুট্টু, টম্বু যার যেমন ভাগ্য তার তেমন নাম জুটেছিল। এ ব্যাপারে কারো কোনো হাত ছিল না।
তার লাইটারের নেশা। পায়জামার দুটো পকেট ও জামার দুদিকে দুটো পকেট মিলিয়ে প্রচুর লাইটার থাকত। বেশীরভাগই অচল। একটি চালু অবশ্যই থাকত, না হলে সে বিড়ি খাবে কী করে। এজন্য বাস ধরে সে যেত এসপ্ল্যানেড। কোন দোকানে যেত আজ অবধি কেউ জানে না। তবে বাসের কন্ডাক্টাররাও তাকে
চিনে গেছিল। কিছু বলত না। টিকিট চাইলে সে কাকুতি মিনতি করে বলত “গরিব মানুষ, মানুষ কোথা থেকে পয়সা পাবো বলো ? দয়া করে ছেড়ে দাও”। বাস থেকে নেমে কন্ডাক্টারের দিকে তাকিয়ে পকেটটা ঠুকে দেখিয়ে বলত “এই দেখো পয়সা আছে, কিন্তু দিই নি, কেমন হয়েছে”? কন্ডাক্টার বলত আচ্ছা ঠিক আছে, পরের বার দেখে নেব। এই ভাবেই সে গোটা জীবন চালিয়েছে। দু তিনমাস অন্তর অন্তর তার বাড়ি ফিরতে দেরি হত। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যেত। তার বাবা অপেক্ষা করতেন তবে আন্দাজ করতেন নির্ঘাৎ আজ মিলন লাইটার কিনতে এসপ্ল্যানেড গেছে। এই রকমই একদিন অপেক্ষা করতে লাগলেন তার বাবা। কিন্তু মিলন আর ফিরল না। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল। রাত গড়িয়ে ভোর। একদিন- দুদিন- তিনদিন। বাড়ির লোকের আশা কমতে লাগল। তবু তার বাবা আশা ছাড়তে রাজি নয়। যে দিকে পারল, খোঁজ করতে লাগল। সকলেই তাকে চেনে। কাছাকাছি বিপদ হলে খবর পাবারই কথা। একসপ্তাহ কেটে যাবার পরে তার বাবাও নিশ্চিত হলেন, মিলন আর ফিরবে না।
সকলেই আশা ছেড়ে যে যার নিজের মত কাজে মেতে গেল। মিলনের বাবার চোখ দুটো সকালে প্রতিদিনই লাল দেখা যেত। সন্তান বেদনা তিনি ভুলতে পারতেন না। আরো বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সকাল বেলা খুব হৈ চৈ। একজন দৌড়ে দৌড়ে এসে খবর দিলো মিলনকে দেখা গেছে। “কোথায় কোথায়” ? বাস স্টান্ডে-বাস থেকে নামছে। বাড়ির লোক, তার ভাই কাকারা সবাই দৌড়ল। মিনিট পনেরো পরে দেখা গেল একটা মানুষের জটলা এগিয়ে আসছে। মধ্যিখানে মিলন। দাড়ি কামানো, গোঁফটা সুন্দর করে ছাটা। একটা কিডন্যাপিং এর দল তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কোমরে একটা ছোট ছুরির আঘাতও দেখা গেল। কিছু কারণে ধরেছিল। এরপর মনে হয় মিলন তাদের কাছে একটা বোঝা হয়ে গেছিল। ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে তারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
লোকের কাছে পয়সা চাওয়া তার স্বভাব ছিল। উদ্দেশ্য লাইটার কেনা। আমরা যেমন গাড়ি, টিভি, মোবাইলের লেটেস্ট মডেল কিনি, সেও সেরকম লাইটারের লেটেস্ট মডেল খুঁজত বোধহয়। চেনা লোকের থেকে খুব একটা চাইত না। অচেনা লোকেদের বেশি জ্বালাতন করত। মাঝে মাঝে স্টেশনে ভিক্ষে চাইতে যেত। ট্রেন ছাড়ার জন্য গার্ড সাহেব বাঁশি বাজাবেন কিম্বা পতাকা নাড়বেন বলে যেই হাত বের করেছেন, মিলন খপাৎ করে ধরেছে হাতটা। গার্ড “ছাড় ছাড়” বলে চিৎকার করছে। ট্রেন আটকে আছে। প্ল্যাটফর্মের লোক শুদ্ধ হ্যা হ্যা করে হাসছে। এসব প্রায়শই দেখা যেত। একবার অন্ধ সেজে বেলুড়মঠে ভিক্ষে করছিল। চোখ বুজে বুঝতে না পেরে নিজের সেজ কাকার কাছে বলে বসেছে “বাবু দুটো পয়সা দেবেন, বাবা মারা গেছে”। সেজ কাকা বললেন “মারব এক থাপ্পড়”। মিলন চোখ খুলে বলল “ওরে শালা, সেজ কাকু রে”। বলেই এক দৌড়। তার কাহিনী বলে শেষ হবে না। আজ লক ডাউনের দিনে চারিদিক স্তব্ধ, ১৯৯৩ সালের সেদিনটাও বন্ধ ছিল। কারণটা ভুলে গেছি। দুপুরবেলা মিলন খেতে আসছে না। প্রায় দুটো বেজে গেছে। স্বভাববশতঃ তার বাবা আবার এদিক ওদিক খুঁজছে। মানাদি বলল মিলন কে সে চান করতে যেতে দেখেছে। সবাই ভাবলো গঙ্গায় গেছে। কেউ কেউ গঙ্গায় ছুটল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল কেউ ওকে দেখেনি। একজন বলল পুকুরটা একবার
দেখতে। দেখা গেল পুকুর পাড়ে মিলনের জুতো খোলা। সবাই বলছে জুতো এখানে, মিলন তাহলে কোথায়। একজন বলল পুকুরে একবার নেমে দেখ দেখি। পুকুর পাড়ে ভীড় হলেও কেউই পুকুরে নামার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে উত্তমদা নামল কোমর জল অবধি। নেমেই বলল “আছে আছে”। সবার শিরা দিয়ে
যেন ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। শ্যামকুলিদাও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিলো। দুজনে মিলে মিলনের পা’টা তুলে যেই দেখাল, সকলের মুখেই একটা আর্তনাদ খসে পড়লো। পাড়ে এনে প্রজ্জ্বলদের রকে শোয়ালো। পেট টিপে জল বের করা হল। সবাই ভাবছে মিলনের জ্ঞান ফিরবে। একজন বলল শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আর আশা
নেই। অনেক কঠিন হৃদয়কেও সেদিন কাঁদতে দেখেছি। সারল্য ভগবানের দান। এটা দিয়ে জগৎ জয় করেছিল সে।
রাস্তায় লোক লোকারণ্য, যেন কোনো মহীরথি শুয়ে আছেন। ভীড় ঠেলে ডাক্তার এলেন। নাড়ি দেখছেন। পাশেই তার বাবা দাঁড়িয়ে। একজন বললেন বাবাকে সরিয়ে নিয়ে যাও। ডাক্তার খারাপ কিছু বললে তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তিনি কিন্তু দিব্যি সহ্য করলেন। ডাক্তার বললেন মিলন আর নেই। হয়ত
বাবাও শান্তি পেলেন এই ভেবে যে যাক গে, আমার আগেই ওর চলে যাওয়া ভালো। কে ওকে দেখবে