ঘরদোর অপরিস্কার থাকলে ঘরে অনেক পোকামাকড় জোটে। আরশোলা তো থাকবেই। ইদুরও আসতে পারে। পিঁপড়ের তো কথাই নেই। সুখী গৃহকোণের এগুলো অঙ্গ হতে পারে না। তাই বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। পিঁপড়ে তাও কিছুটা সহ্য করা যায়। কারণ সহজেই তাকে দমন করা সম্ভব। আরশোলাকে নিয়ে
একটা সুবিধা হল, সেটি চট করে মানুষের সামনে আসে না। দেখলেই বিদ্যুৎ গতিতে লুকিয়ে পড়তে সচেষ্ট হয়। তবে রাতে সকলের অলক্ষ্যে তারা স্বর্গরাজ্য খুঁজে পায়। কোনোদিন হঠাৎ মাঝ্ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তার নিদর্শন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। আরশোলাকে মারার জন্য বহুজাতিক সংস্থা রীতিমতো ব্যবসা
ফেঁদে বসেছে অনেক রকমের প্রোডাক্ট বের করে। ইঁদুরকে বাড়িতে রাখা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ ইলেকট্রিকের তার ও মূল্যবান বই নষ্ট করায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। তাকে শায়েস্তা করার জন্যও বিভিন্ন ছল কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে শহরের গেরস্থ বাড়িতে যদি ব্যাঙের আবির্ভাব হয় তবে তা এক অন্য
মাত্রা পায়।
আমার একটু রাত করে শোয়া অভ্যেস। ফলে নিস্তব্ধ রাতের বাড়ির প্রতিছবি মাঝে মাঝেই চাক্ষুষ করতে পারতাম। প্রতিরাতেই দেখতাম একটা পুঁচকে ব্যাঙ দালান পার হচ্ছে। তার সাইজ হবে বড়জোর এক গাঁট। বাল্যকালে বোধবুদ্ধিহীন সেই প্রাণ সারারাত হয়ত ইতস্তত ঘুরে বেড়াত। আমার পায়ের শব্দে সে
লুকোতে চাইত। কিন্তু ঠিক চোখে পড়ে যেত। আমি তো ভেবে অবাক হয়ে যেতাম যে ব্যাঙটা ঢুকলো কোথা দিয়ে। কারণ রাস্তার নর্দমা থেকে বাড়ির মেঝে বেশ উঁচুতে। বাড়ির নর্দমাতেও জালতি লাগানো। অতএব বড় ব্যাঙ ঢোকার কথা নয়। এটি সাইজে এতটাই ছোট যে জালতির ফাঁক দিয়ে ঢুকলেও ঢুকতে পারে। কিন্তু
তাকে ধরা যেতো না। এক লাফে লুকিয়ে পড়ত। সে এতটাই ছোট ছিল যে তাকে আমি অবহেলা করতাম। ভাবতাম এর ক্ষতি করার মুরোদ নেই। তবে মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিত। আজকের এই পুঁচকে একদিন তো বড় হবে। সেদিন এটার ভয়ঙ্কর রুপ আমি সামলাবো কী করে ? আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। বেশ কিছুদিন চোখের আড়াল ছিল বলে ভেবেছিলাম বোধহয় পাপ বিদায় হয়েছে। বেশ কয়েকমাস পরে হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে চোখ ছানাবড়া। বেশ ডাগর ডোগর হয়েছে।
নেয়াপাতি মার্কা একটা ভুড়ি জোগাড় করেছে ব্যাটা। এখন তার লাফের দৈর্ঘ্য বেড়েছে। তবে কিছুটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করছি। রাতে বাথরুমে যাবার সময় আগে দেখতাম আলো জ্বাললেই সে পালাত। এখন দেখি ব্যাটা ঘ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। কাছাকাছি গেলে লাফ মারে।
আমার বাড়িতে থাকছে অথচ আমাকে ভয় পাচ্ছে না। এটা মাঝে মাঝে আমার আত্মসন্মানে লাগে। কট্মট্ করে তাকাতাম। কিন্তু কিছু করার নেই। না পারব পা দিয়ে মারতে। কারণ দেবে গায়ে —, মানে আর কি যাকে শুদ্ধ ভাষাতে বলে ব্যাঙের প্রস্রাব। একটা উপায় ছিল ঝাঁটা মেরে তাড়ান। কিন্তু লুকিয়ে
পড়লে তাকে খুঁজবে কে। তাছাড়া মাঝরাতে ওসব সম্ভব নয়। এদিকে বাড়িতে একটি নেংটি ইঁদুরের উৎপাত লক্ষ্য করেছি। দু একটা কগজের টুকরো দেখেই আন্দাজ করেছিলাম সেটা। একদিন স্বচক্ষে সেটির দর্শন পেলাম। চালের ব্যাগটা সরাতে গিয়ে দেখি কী একটা তুরুক করে বিদ্যুৎ গতিতে উধাও হয়ে গেল। বুঝে নিলাম ইঁদুরের উপস্থিতি। এই অবস্থায় চুপ থাকা যায় না।
ইদানিং একধরনের আঠা লাগানো প্যাড বেরিয়েছে যেগুলো পেতে রাখতে হয়। তাতে ঘন চ্যাটচ্যাটে আঠা লাগানো থাকে। হাতে লাগলে হাত আটকে যাবে।
অনেক আশা নিয়ে সেটিকে আলমারির তলায় পাতলাম ইঁদুর ধরার জন্য। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দূর থেকে দেখেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল, পড়েছে ধরা। কাছে গিয়ে দেখি, সেটা ইঁদুর তো নয়, সেই শয়তান ব্যাঙ। তবে ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন ইঁদুর ধরা পড়লে যে সাফল্যের আনন্দটা হয়, এক্ষেত্রে সেটা হল না।
কারণ যা ধরতে চেয়েছি তা অধরাই রইল। তাছাড়া ব্যাঙ সেই অর্থে ক্ষতিকারক নয়। গায়ে উঠলে গরল হতে পারে। তবে সখ করে সে মানুষের গায়ে ওঠে না, যদি না আমরা তার গায়ে উঠি। উল্টে ছোটোখাটো আরশোলা খেয়ে সে আমাদের উপকার করে। তার জীবনের এই পরিণতি আমি চাইনি।এ আঠা ছেড়ে জীবনে
সে বের হতে পারবে না। ধীরে ধীরে এ ছোট্ট প্রাণ নিষ্প্রদীপ হবে। ধড়ফড় করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, যেমন ইদুরগুলোর পরিনতি হয়। আমি আর সেদিকে তাকালাম না। পরের দিন সকালে এসে প্যাড সমেত শবদেহটা ছুঁড়ে ফাঁকা জমিতে ফেলে দেব ঠিক করলাম।
পরের দিন প্যাডটা ফেলতে গিয়ে দেখি ব্যাঙটা নেই। কিছুটা আঠা এলোমেলো অবস্থায় আছে। ওখানেই আটকে ছিল ব্যাটা। কোনোভাবে নিজেকে ছাড়াতে পেরেছে। জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে বোধহয় সপাটে লাথি চালিয়েছে। তাতেই কেল্লা ফতে। আনন্দে আমার মন্টা ভরে উঠল। যাক বাবা আর প্রাণী হত্যা করতে
হলনা। তবে এই জীবন মরন যুদ্ধে সে যে বিধস্ত হয়ে গেছিল, তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। অক্ষম বৃদ্ধদের মতো কোনো মতে শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলেছে মনে হয়। শরীরের তলদেশে আঠাটা লেপ্টে আছে। তাই মাটিতে শরীরটা আটকে যাচ্ছে। আমি যে পেছনে দাঁড়িয়ে আছি তাতে তার কিছু করার নেই। আমি
তাকে মেরে ফেললেও তার পালাবার উপায় নেই। অগত্য সে নিজেকে সমর্পণ করেছে নিয়তির হাতে। এ অবস্থায় এই অসহায় নিসম্বল প্রাণটিকে দেখে আমার মনে কেমন দয়ার উদয় হল। মনে হল ভগবান কাউকে এত কষ্ট দিতে পারে ? তাকে দেখে মনে হয়েছিল এর আয়ু এক কি দুদিন। চোখটা তার থেকে সরিয়ে নিলাম তার কষ্ট ভোলার জন্য। তাকে ছেড়ে আমার নিজের কাজে ডুব দিলাম। পরের দিন রাতে যথারীতি উঠে বাথরুমে যাবার সময় একটা দরকারে পাশের ঘরের দরজাটা যেই
না খুলেছি, একটা পচাৎ করে আওয়াজ হল। দরজার তলায় কিছু একটা রগড়ে গেল মনে হল। দেখি সেই ব্যাঙটা দরজার তলায় চিপটে গেছে। যন্ত্রনায় সে ছটফট করছে। আধমরা অবস্থায় তাকে দেখে একটা কথাই মনে হল, আমার হাতেই তোর মরন ছিল। না হলে আঠার প্যাড থেকে লাফিয়ে বেঁচেও সেই এখানেই মরলি?
দরজার পাল্লার তলায় কতটুকুই বা ফাঁক থাকে। সেখানে ও চিপটে গেল। ওর কিছু করারও ছিল না। মাটিতে শরীরটা আটকে থাকলে ও পালাবেই বা কী করে।
ব্যাঙ হত্যার দায় মনে মনে স্বীকার করে সেই রাতে শুয়ে পড়লাম। সেই মুহূর্তে আমার কিছু করার নেই। কারণ যতক্ষন না তার পূর্ণ মৃত্যু আসছে, অপেক্ষা করতে হবে। আধমরাটাকে নিয়ে ফেলব কোথায়। বিছানায় শুয়ে কিন্তু আমার ঘুম এল না। সারারাত ছট্ফট্ করলাম তার যন্ত্রনার কথা ভেবে। একটা
মানুষেরও তো এই হাল হতে পারে। তাকে ছেড়ে কি আমি ঘুমোতে পারতাম? সকালে উঠে প্রথমেই মনে হল ব্যাঙটাকে দেখি। দরজার কাছে গিয়ে দেখি সে নেই। মরে গেলে পড়ে থাকত। অথবা কোনোরকমে ঘষে ঘষে কোথাও গিয়ে মরেছে। খোঁজাখুঁজির দিকে না গিয়ে নিজের কাজে মগ্ন হলাম। সেই রাতেও তাকে দেখতে পেলাম না। পরের মাঝ রাতে উঠে দেখি সে হাঁটছে বটে তবে শরীরে নির্ঘাৎ অসহ্য যন্ত্রনা। কারণ পেছনের পা দুটো পুরোপুরি বেঁকে গেছে। বাতের ব্যাথায় জর্জরিত বৃদ্ধ মানুষেরা লাঠি নিয়ে বাঁকা পায়ে যেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, ব্যাঙটাকে দেখে তাদের কথা মনে হল। ভাবলাম জীবনী শক্তি নেহাৎ কম নয়। আগে হলে চাইতাম ব্যাঙটা চলে যাক। এখন আমার পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এখন চাইছি ব্যাঙটা থাকুক। কোথায়ই বা যাবে। লড়াই করার ক্ষমতা ভগবান কেড়ে নিয়েছে। রাস্তায় ও মরেযাবে। তারচেয়ে এখানেই থাকুক।
ইদানিং রোজ আমি রাতে উঠে ওর খোঁজ করতাম। এটাই কী প্রেম? রোজই দেখতে পেতাম দালানে পাইচারি করতে। আমাকে দেখে পালাবার উপায় নেই। চেষ্টাও করত না। ও বোধহয় বুঝেছিল আমার মনের কথা। মনের কথার আদান প্রদান না হলে প্রেম জমে না। ওর একদম কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম, কিন্তু আমায়
ভয় পেত না। ওই সামান্য একটা ব্যাঙ যে আমার চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে আবর্তিত হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। পশুপাখির প্রতি আমার অনুভুতি শক্তির যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। ‘তাদের কষ্টে আমার কষ্ট’ এই আপ্তবাক্যটি আমার যপমন্ত্র হয়ে উঠল। আজ সে নেই। নেই মানে সে নিরুদেশ। অনেক খুঁজেছি, কোথাও পেলাম না। পর্বতাভিযানে পর্বতারোহীর দেহ যেমন নিখোঁজ হয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না, এও সেরকমই হল। পালাল নাকি মরে
গেল নাকি বেড়ালে আঁচর দিলো, কিছুই বুঝলাম না। শুধু দেখলাম একদিন সে অদৃশ্য। রাতে যখনই উঠি, আজও প্রতি রাতে তার খোঁজ করি। থাকলে কতটা হতো জানি না, নেই বলে মনটা বেশি বেদনাহত হয়। অল্পদিনের নাতিদীর্ঘ স্মৃতি তো। তাই সবটাই তাজা। প্রতিদিনের ছবিটা প্রতি রাতে জেগে ওঠে। আর ওর ওই
ভগ্ন শরীরের কষ্টটা উপলব্ধি করি।
কতদিন ভেবেছি মোবাইলে ব্যাটার একটা ছবি তুলে রাখব। রাতে যখন উঠে গিয়ে তাকে চোখে পড়ত, মনে হতো মোবাইলটা নিয়ে আসি। তারপর ভাবতাম, ধুর আজ নয়, কাল দেখা যাবে। রোজই তো আসে। সেই ভাবনাটাই কাল হল। ঋষিমুনিদের আপ্ত ব্যাক্য “যা আজ ভাবছ, আজ করে ফেলো। কালের আশায় থেকো না”। এখন যেন নিশ্চিত হয়ে গেছি আর ওর দেখা পাবো না, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে। অলৌকিক আজও ঘটে। সেই আশায় দিন গুনি। ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারিনা। ব্যাঙেই এই মানুষ হলে না জানি কী হতো।