একটি চুরি যাওয়া সাইকেল
একটি চুরি যাওয়া সাইকেল
পর্ব - ১
আমি চলেছি জম্মু থেকে কাশ্মীর, তাও আবার সাইকেল চালিয়ে। যাবো লাদাখ। যারা গেছে তারা জানে, জম্মু থেকে কাজিগান্ড পর্যন্ত ১৭৫ কিমি রাস্তা বরাবর উঁচু। যেখানে দেখে মনে হয় রাস্তা উঁচু নয় সমান্তরাল, সেখানেও রাস্তা সামান্য উঁচু। সে উঁচু চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। গাড়িতে গেলেও বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সাইকেলে গেলে পায়ের চাপে মালুম পাওয়া যায় এই উঁচুর কষ্ট। তাছাড়া ভৌগলিক অবস্থানের জন্য জম্মুর গরম খুব ভ্যাপসা। সেখানে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘামে। রোদে চললে তো কথাই নেই। শরীর শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি রাস্তা যেমন উঁচু নিচু হয় সেরকম, মাঝে মাঝে নামা তো থাকবেই। তবে সে সামান্যই। এই পথে চালাতে চালাতে Ramban’এ এসে হাজির হলাম। রামবানের গরমও অনেকটা জম্মুর মতো। সকলেই বলছিল এরপর ৬ কিমি চড়াই রাস্তা। সেই উঁচু পথ পেরোতে যত না কষ্ট, তার চেয়ে বেশি কষ্ট ডিহাইড্রেশনের জন্য। আমি বলি, জম্মু থেকে রাস্তা সাইকেল চালানোর জন্য মোটেই আদর্শ নয়।
এই ভাবে চলতে চলতে Ramban থেকে আরও ২০ কিমি দূরে অনেকগুলো টানেল পেরিয়ে Ramsoo পৌঁছলাম। রাস্তায় এত জ্যাম যে হাঁটতেও অসুবিধে হচ্ছিল। যদিও বেশিরভাগ রাস্তাটাই হেঁটে উঠলাম। Ramsoo’তে এসে মনে হল আর পারছি না। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। ফলে এখুনি ঘর খুঁজতে হবে। প্রথমে এল Ramsoo পুলিশ স্টেশন। একবার ভাবলাম এদের বলি যদি রাতে থাকতে দেয়। তবে পুলিশ স্টেশনে সাধারণত বলে অন্য কোথাও থাকতে। তাছাড়া O.C. এর সাথে দেখা করে তাঁকে সব বোঝাতে বোঝাতেই সময় চলে যায়। তারপর অন্য জায়গা খোঁজার সময় পাওয়া মুশকিল হয়ে পরে। তাই একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি। জায়গা যে পাচ্ছিনা তা নয়, তবে রাস্তার ধারে প্রচন্ড ধুলো। থাকতে মন মানছে না।
ডানদিকে একটা মন্দির দেখলাম একটু উঁচুতে। কিন্তু সিঁড়ি ভেঙ্গে যাবার মতো পরিস্থিতি নেই। আর একটু এগিয়ে একটা মোড় বেঁকতেই একটা ছেলে দেখি হাত নেড়ে ডাকছে চা খেতে। ডাকটা শুনেই মনে হচ্ছে সে খাওয়াবে। আমারও একটু কথা বলার দরকার ছিল রাতে থাকার ব্যাপারে। ফলে তার কাছে গিয়ে বসলাম। সে বলল, “কী খাবেন বলুন – চা না দুধ”? একটু ভেবে আমি বললাম দুধ। তার মাঝেই সেরে নিলাম কথা যে রাতে কোথায় শোয়া যায়। সে বলল এখানে পাশেই শুয়ে পড়ুন। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর ধুলো ছিল। তাছাড়া কেমন যেন মনে হল ছেলেটা বলেই খালাস। একটু পরেই চলে যাবে। তারপর আমি একা। মরি আর কি। কেউ এসে বলবে উঠে যেতে। কিন্তু দেখলাম সে’ই দোকানের মালিক। আমাকে দুধ দিল, টাকা নিল না।
আমি ধুলো বালি মেখে আর একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে চেনাবের উপনদীর ওপর একটা ছোট সেতু দেখলাম। তার ওপাশে ছোট কুটুরির মতো একটা ঘর। সেটা যে দোকান সেটা বুঝতে পারছিলাম কারণ গুটিকয়েক লোকজন সেখানে আড্ডা মারছিল। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। সেতু পেরিয়ে গুটি গুটি তাদের দিকে এগিয়ে চললাম। দোকানদারটা একটি বুড়ো মানুষ। ভাবলাম তার কাছেই সব কিছু খুলে বলা উচিৎ। তার কথার বেশি ওজন থাকবে। বুড়ো দোকানদারটাকে কিছু বলতে যাবার আগেই সে তড়াক্ করে লাফিয়ে পাশে একটি যুবক ছেলের গা ঘেঁষে বসল। কিছু যে তাকে বলব, সে না শোনার ভান করে রইল। অগত্যা সেই যুবকটিকেই যা বলার বলতে হল। আমি রাতে এখানে থাকতে পারি কিনা জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল হ্যাঁ পারি। মানুষজনের বসার জন্য মাটি থেকে একটু উঁচু সিমেন্টের চাতালের ওপর বসার জায়গা বানানো। মাথার ওপর ঢালাই ছাদ। জায়গাটা ভালো করে ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করলাম। টেন্টটা ওখানেই খাটালাম। মাটি থেকে একটু উঁচু হওয়ায় ধুলো ঢোকার সম্ভবনা কম। প্রায় আট দশজন ছেলেপুলে আমাকে ঘিরে এদিক ওদিক জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। তারা আমার সাইকেল তা নিয়ে ব্যাস্ত। কত দাম জিজ্ঞাসা করছে। দাম শুনে তাদের চোখ কপালে। আমাদের এখানে এটা হয়তো কিছুই নয়। তবে তাদের কাছে এটা আকাশ ছোঁয়া। তবে সকলেই একই কথা বলছে। কোনো ভয় নেই। শুয়ে পড়ুন। নিশ্চিন্তে রাত কাটান। এখানে ভয়ের কিছু নেই।
টেন্ট খাটিয়ে সবকিছু গুছোতে সময় লাগে। ৮’টার সময় দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল। জায়গাটা শান্ত হয়ে গেল। পাশ দিয়ে চেনাবের উপনদী বয়ে চলেছে কুলকুল করে। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও প্রচণ্ড ধুলোর মধ্যে আছি বুঝতে পারছি কারণ গাড়ির আলো পড়লে ধুলোগুলো স্পষ্ট হচ্ছে।
গ্রামটার নাম Hingni. এখানে সমস্যা হল কাছাকাছি কোথাও জল নেই। একজন একটা আলো দেখিয়ে বলেছিল ওখানে জল পাওয়া যাবে। খাওয়া ও স্নান দুই-ই করা যাবে। তখন শরীর ক্লান্ত ও ধুলোয় ভর্তি। স্নান না করলে চলছে না। অন্ধকারেই সাইকেল চালিয়ে চললাম গা ধুতে ও জল আনতে। কপালে আলো লাগিয়ে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় চলেছি নিচের দিকে। চারিদিক অন্ধকার। কোনো রকমে খুঁজে পেলাম জায়গাটা। গা ধুতে যেই যাবো, দেখি অন্ধকারে একটা টর্চ নিয়ে হন হন করে একজন এগিয়ে এল। জানতে চাইলো আমার পরিচয়। এত রাতে এই পাহাড়ি অভ্যন্তরে আমি অচেনা এক মানুষ। ভেবেছে বাজে ধান্দা আমার। পেছন পেছন দেখি আর একটা লোক “কৌন কৌন” বলতে বলতে দৌড়ে দৌড়ে এল। তার হাতেও টর্চ। আমি শান্ত ভাষায় সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। সবকিছু বুঝলেন তারা। এ জল যে পাণীয় তা তারা নিশ্চিন্ত করলেন। কোথায় তিনি গেলেন কে জানে, আমি স্নান করে সাইকেলটা যেই নিতে যাবো, তিনি আবার হাজির। আবার কিছু প্রশ্ন করলেন। তবে এবারের প্রশ্নগুলো অনেক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। রাতে তো কিছু খেতে হবে। ভেবেছিলাম এখান থেকে জল নিয়ে গিয়ে রান্না করব। রান্না করতে জল তো লাগবে। তাঁকে বললাম যদি একটা বোতল থাকে তো দিতে। তিনি এতই ছোট একটা বোতল দিলেন যে তাতে হবে না। আমি তাঁকে বললাম থাক। বরং রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে এখানে এসেই রান্না করব। তিনি বললেন তাতে অসুবিধে কিছু নেই। তবে রান্নার সময় চারিদিক ভালো করে দেখে নিতে। এখানে বড্ড সাপের উপদ্রব। আমি বললাম এই মেরেছে। এখানে আবার সাপ আছে নাকি। যেখানে টেন্ট পেতেছি সেখানেও সাপ আছে? তিনি বললেন, “না। ওখানে বন জঙ্গল নেই”। আমি বুঝলাম এখানে বন জঙ্গল আছে। তাড়াতাড়ি কেটে পড়াই ভালো। ফিরে চললাম।
টেন্টে এসে দেখি সেই দোকানদার বুড়ো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। আমি কোথায় গেছিলাম জানতে চাইলেন। বললাম স্নান করতে। জিজ্ঞাসা করলেন কিছু খেয়েছি কিনা। কোনো দোকান নেই। রান্নার করার অসুবিধা। এসব দেখে তিনি তার বাড়িতে খাবার প্রস্তাব দিলেন। তার অতিথি সেবার মনোভাবে আমি মুগ্ধ হলাম। কিন্তু কোথায় যেতে হবে জানতে চাইলে তিনি হাতটা দেখালেন পাহাড়ের ওপরের দিকে। আমি বললাম যেতে কতক্ষণ লাগবে। বললেন আধ ঘণ্টা। তখন বেজে গেছে রাত দশটা। শরীরের ওপর যা ধকল গেছে, আমার পক্ষে পাহাড় ভেঙ্গে আধ ঘণ্টার রাস্তা যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হলাম। বললাম, একটা মানুষ এক রাত্তির না খেলে মরে না। কোনো চিন্তা নেই। সঙ্গে কাজু, কিসমিস, খেঁজুর আছে। ওই খেয়ে শুয়ে পড়ব। বলতেই তিনি ঘরে চলে গেলেন। পাহাড়ের ঢালে দু পা বাড়াতেই বয়স্ক লোকটা কেমন মিলিয়ে গেলেন। আমি এবার শোবো বলে ভাবছি, একটা স্কুটার এসে দাঁড়াল। এমনিতে যাতায়াতের পথে দু একটা লোক মাঝে মধ্যে আমাকে দেখে অবাক হয়ে আমার কথা জিজ্ঞাসা করছে। ছেলেটিও সবকিছু শুনে খেয়েছি কিনা জানতে চাইলো। আমি বললাম জলের অভাব। তার কাছে একটি বড় জলের ড্রাম ছিল। তিনি বললেন কারখানায় গিয়ে কিছুটা রেখে দিয়ে বাকি পুরোটাই আমাকে এসে দিয়ে দিয়ে যাবেন। আমি স্থির করলাম তাহলে তো রান্না করা যেতেই পারে। সারাদিনের কষ্টের পর খিদে লেগেছে ভালোই।
আমার কাছে ছোট্ট বোতলে যা জল ছিল তাই দিয়ে রান্না শুরু করলাম। ভাত ফুটতে শুরু করলে ততক্ষণে কারখানার লোকটা তো এসেই পড়বে। কিন্তু সে আর আসেনা। এদিকে চাল ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। আমি পড়েছি বিপদে। না পারছি জল আনতে। জ্বলন্ত স্টোভ ছেড়ে যেতে পারছি না। জল কমে এসেছে। এবার ভাত পুড়ে যাবে। অর্ধেক ফোটা ভাত, না পারছি স্টোভ বন্ধ করতে। শেষমেশ সবকিছু ছেড়ে জল আনতে দৌড়লাম। খুব রাগ ধরল ছেলেটার ওপর। ভাবলাম, আমাকে এভাবে ফাঁসানোর কী দরকার ছিল। জল দেবোনা বললে তো আমি আর রান্না করতে যেতাম না। যাই হোক, তাড়াহুড়ো করে জল এনে দেখি সেই ছেলেটা এসে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবছে, ফাঁকা জায়গায় কেউ নেই। একা একটা স্টোভ জ্বলছে। সে ঘাবড়ে গেছে। আমি এসে তাঁকে বললাম, আপনার জল আনতে দেরি হচ্ছে দেখে ভাবলাম আর হয়তো আসবেন না। তাই নিজেই জল আনতে গেছিলাম।
রান্নার শেষে শোবার আগে সাইকেলটাকে মাথার কাছে রাখলাম। সাইকেলটাকে লক্ করলাম বটে তবে কোথাও শক্ত খুঁটিতে বাঁধার মতো কিছু পেলাম না। এই প্রথম সাইকেলটাকে খোলা আকাশের নিচে কিছুর সাথে না বেঁধে রাখলাম। স্থানীয় ছেলেগুলো এত ভালো ব্যবহার করেছিল যে মনে বেশ ভরসা এল, এখানে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। টেন্ট থেকে অবশ্য চোখের সামনে সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। এই করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। মনে হয় রাত ১২’টা।
ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল ঠিক সকাল ৪টের সময়ে। সকাল সকাল বের হবার দরকার ছিল। কারণ অনেকটা দূর যেতে হবে। ঘুম ভেঙ্গে বাইরে চোখটা যেতেই বুকটা ভেঙ্গে গেল। ভাবলাম ভুল দেখছি। দু একবার চোখ মুছে ভালো করে দেখলাম। চট করে চেনটা টেনে টেন্টের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সাইকেলটা নেই। আজ অবধি এমন ঘটনা ঘটেনি। তাই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা যে সাইকেল চুরি যেতে পারে। ভাবছি সাইকেলটা কী আমি অন্য কোথাও রেখে শুয়েছি? ভালো করে এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলাম। এমনও তো হতে পারে যে কারো অসুবিধে হয়েছে বলে সেটি কেউ অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ খোঁজার পর এটুকু মনের মধ্যে বিশ্বাস এল যে সেটি চুরি গেছে।
কাল রাতে খাবার সময় পাশের কারখানার একটি সিকিউরিটি এসেছিল। কারখানার নাম “AFCON”। বানিহাল থেকে টানেল তৈরি হচ্ছে বানিহাল – উধমপুর সংযুক্তিকরণের জন্য। কাজ প্রায় শেষের মুখে। আর কয়েক মাস মাত্র টানেলের কাজ বাকি। এরপর রেল দায়িত্ব নিয়ে নেবে লাইন বসানোর জন্য।
সেই সিকিউরিটি সব কিছু জেনে নিয়ে আমাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল রাতে কিছু দরকার হলে ডাকতে। সকালে ৪.৩০ এ তাকে ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “আমার সাইকেল চুরি হয়ে গেছে”। সে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি কী জানি। আমি তো আছি ভেতরে”। যেন আমি তাকে দোষ দিচ্ছি। আমি বললাম “আমি সে কথা বলিনি। আপনি কি একবার আসতে পারবেন”?
সে অবশ্য ৫ মিনিটের মধ্যে চলে এল। একটা ঘটনা ঘটলে অচেনা জায়গায় অনেককেই সন্দেহ হয়। প্রথমে ভাবলাম এ কোম্পানির লোকগুলো এসব ঘটালো না তো? কিন্তু মানুষের সাথে কথা বলে ও কার্যকলাপ দেখে অনেককিছু বুঝতে পারা যায়। এরকম ঘটনা ঘটলে মনে একটা ভয় ঢোকে। কিন্তু সে চলে আসাতে একটু সাহস পেলাম। সে এদিক ওদিক টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজতে শুরু করলো যদি সাইকেলটা কোথাও পড়ে থাকে। সবসময়েই মনে একটা আশা জাগছে যে এই বুঝি সে একটা কিছু করবে আমার জন্য। কিন্তু সে বলল সকাল আটটা অবধি অপেক্ষা করতে। তখন ডিউটি চেঞ্জ হয়। কেউ একজন আসবে পরের ডিউটিতে। সে যদি কিছু করতে পারে। আমি বুঝলাম এর দৌড় শেষ। এরপর আমার কী করনীয় তা খুঁজতে হবে। এরা আসলে স্থানীয় না হবার কারণে নিজেরাই ভয়ে ভয়ে থাকে। মার খাবার ও প্রাণের ভয় থাকে। (কাল রাতেই এই গ্রামের একজনের সাথে এর ঝগড়া দেখেছিলাম)। কারখানার মালপত্র চুরি হয় বলে অফিসের কৈফিয়ত দেবার ভয়ও থাকে। তাই সকালে এসে নিজেদের মালপত্রও দেখে গেল সেই সুযোগে।
সকাল ৫’টায় একটা পণ্যবাহী ছোট গাড়ি এসে দাঁড়ালো। তার ড্রাইভার এসে আমার সাথে কথা বলতে চাইলো। আমি এবার চেষ্টা করলাম লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিতে সাইকেল চুরির খবর। যদি রাস্তায় সে চোর ধরা পড়ে। সে তো খুব অবাক। এবং চোরকে খুব গালাগালি দিতে শুরু করলো। এখানে একটা গালাগাল খুব জনপ্রিয়। সেটি লেখার অযোগ্য হলেও লিখতে হচ্ছে (বহেন ____) কারণ বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই অবলীলায় এ শব্দ উচ্চারণ করে। রাস্তার লোক থেকে সরকারী বড় অফিসার, ডাক্তার, উকিল, ভদ্রসভ্য সমাজের মানুষজন, দোকান বাজারে, গাড়িতে, সবাই সবাইয়ের সামনে এটা বলতে অভ্যস্ত। উধমপুরের পর থেকেই এটা লক্ষ্য করেছি।
ইতিমধ্যে দেখি সেই বুড়ো দোকানদার এসে হাজির। কাল বলেছিল সকাল আটটায় দোকান খুলবে। এত সকালে সে কী করছে। টেন্টের ভেতর থেকে কিছু না বলে আমি চুপচাপ তাকে লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। দোকান খুলে কি সব লোহার সরঞ্জাম সে গাড়িতে তুলতে লাগলো। কার্যকলাপ দেখে যা মনে হচ্ছিল, চোরাই লোহা পাচার হচ্ছে। ভাঙ্গা লোহার টুকরো, তারের জালি, সব গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ছোট ছোট বস্তাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ভারী। যতটা শীঘ্র সম্ভব, সবাই মিলে নিঃশব্দে কাজ করছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমি কিছু না বোঝার ভান করে চুপচাপ শুয়ে আছি অন্যদিকে তাকিয়ে। আমার সন্দেহ হচ্ছে লোহালক্কড় পাচার হচ্ছে। পাশেই রেলের কারখানা। শুনেছি সেখান থেকে রোজ মালপত্তর চুরি যায়।
সবটুকুই আমার সন্দেহ। কারণ তাদের গতিবিধি সে কথাই বলছে। কিন্তু একথা কাউকে বলার নয়। আবার আমার ধারণা সত্য নাও হতে পারে। তাদের কাজ শেষ হলে গাড়িটা নিঃশব্দে চলে গেল। বুড়ো কী বলে দেখছিলাম। কারণ তার গতিবিধি শুরু থেকেই আমার কাছে সন্দেহজনক ছিল। আমার খবর জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বলে দেখলাম – “আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে”। ইচ্ছে করে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বললাম তার অভিব্যাক্তি জানার জন্য। তিনি বেশ অবাক হলেন। এমনিতেই তার মুখের অভিব্যাক্তি কম। সব শুনে বললেন রাতে তার খুব ভুল হয়ে গেছে। মালপত্তর উচিৎ ছিল দোকানে ঢুকিয়ে রাখা। তাহলে আর এই সর্বনাশটা হতো না। আমি মনে মনে ভাবছি সেটা তো কাল ঘুণাক্ষরেও বললে না বাবা। তারপর আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বললেন আমি কেন তাকে বলিনি দোকানে সাইকেলটা রাখার কথা। তখন আমি বলতে বাধ্য হলাম যে আপনার দোকান। আপনি না বললে আমি কী বলতে পারি? তাছাড়া আপনিই তো বললেন এখানে টেন্ট খাটাতে। এখানে নাকি কিছু ভয় নেই। তখন তিনি বললেন এর আগে এখানে কখনো আর এরকম ঘটনা ঘটেনি। এই প্রথম ঘটলো। এ নির্ঘাৎ কোনো বাচ্চা ছেলের কাজ। বড়রা এ কাজ করবে না। বললেন Hingni গ্রামে গিয়ে বলতে যদি ওরা কিছু সন্ধান পেয়ে থাকে সাইকেলের। আমি বুঝলাম ওই গ্রামে তার কোনো প্রভাব নেই। উনি নিজে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। অর্থাৎ সে সুযোগটাও গেল। এখন আবার মনে হচ্ছে এ বোধহয় চুরির সাথে যুক্ত নয়। নাহলে এত কথা কি বলত?
এবার আমি ফোন করলাম সর্দার প্রীতম সিং জী কে। জম্মু কাশ্মীরে এনার বেশ একটা প্রভাব আছে। অনেককেই তিনি চেনেন। এনার কাছে আমি Batote এ এক রাত ছিলাম। Batote হল Patni Top এর কাছে একটি পাহাড়ি গ্রাম। সব শুনে তিনি বললেন এ জায়গাটা বাজে। এখানে চুরি হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে এখানে থাকা উচিৎ ছিল। আমার এই বেহিসেবি কাজের জন্য তিনি কিছুটা ক্ষুণ্যও হলেন। বললেন এখন উচিৎ হচ্ছে পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করা। আমি বুঝলাম আমার শেষ সুযোগটাও গেল। এখন কাঁচুমাচু মুখে গুটি গুটি বাড়ি যাওয়া অথবা পুলিশ থানায় যাওয়া, এই দুটি বিকল্প আমার কাছে খোলা।
ওদিকে দোকানের বুড়ো (নাম- আব্দুল গানি) বলেছিল ৫টা নাগাদ গ্রামে গিয়ে বলতে। তখন আকাশে আলো ফুটবে। সেই মতো গ্রামে গেলাম। কালকে যেখানে জল আনতে গেছিলাম তার পাশের বাড়িতেই গেলাম কারণ ওই বাড়ির ছেলেটিই আমাকে চিনত। কাল রাতে স্নান করার সময় কথা হয়েছিল তার সাথে। তার বাড়ির সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ডাকলেও কেউ সাড়া দিল না। এদিকে টেন্টে মালপত্তর রয়েছে। সেগুলোও চুরি হয়ে গেলে কেল্লা ফতে। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে গেলাম টেন্টের কাছে। সেখানে একটা দুটো করে লোক চলাচল শুরু করেছে। সকলকেই বলছি। সকলেই অবাক। অনেকেই কাল আমাকে দেখেছে শোবার তোড়জোড় করতে। তাই তারা বেশ সহানুভূতিশীল। সকলেই বলছে পুলিশে অভিযোগ জানাতে। এসে ডান্ডার বাড়ি দেবে, ঠিক সাইকেল বেরিয়ে যাবে।
এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে এরা অন্তত চুরির সাথে যুক্ত নয়। মুখের ভাষা সে কথাই বলছে। কিছুক্ষণ পর আবার গেলাম জলের কাছে সেই বাড়িতে। এবার দেখা পেলাম ছেলেটির বাবার। বয়স্ক সেই মানুষটি আমার ক্ষতির কথা শুনে বেশ কষ্ট পেলেন। মুখে চোখে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠলো। “হে আল্লা হে আল্লা” বলে বুকে হাত বোলাতে লাগলেন। দুটো ঠোঁট তার কাঁপতে লাগলো। আশেপাশের লোকজনকে তিনি আমার কথা বলতে লাগলেন। বললেম আমি একজন মুসাফির। যেই করুক এই কাজ, আমার সাথে অন্তত এই কাজ করা উচিৎ হয়েনি। আল্লা তাকে ক্ষমা করবে না।
ফিরে এসে দেখি কারখানার সেই কালকের ছেলেটি যাচ্ছে স্কুটার নিয়ে, যে কালকে জল দিয়ে উপকার করেছিল। মাঝে তাকেও একবার সন্দেহ হয়েছিল আমার। তবে আজকে সে বেশ হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলো কেমন ঘুম হল। আমি বললাম ভালো হয়েছে তবে সাইকেলটি নেই। চুরি হয়ে গেছে। চুরির কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়ল। মুখ দেখে বুজলাম সে কিছু জানতো না। আমি বললাম ভাবছি পুলিশ স্টেশনে যাবো। সে বলল স্কুটারে করে সে আমাকে নিয়ে যাবে। বলে সেতু পেরিয়ে ওপারে গেল একটু টিফিন করতে। আসলে আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম মালপত্তর নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। কারণ পুলিশ সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা, তারা কী’ই বা করতে পারে। এত বড় পাহাড়ে কোথায় কে কাকে খুঁজবে। স্থানীয়রা বলাতে পুলিশের কথা মাথায় এল। কিন্তু একা একা যেতে কেমন ভয় ভয় করছিল। তখনই গ্রাম থেকে বাচ্চাদের নিয়ে একটা বাস থানার দিকে যাচ্ছিল। আমি তাতে চড়ে বসলাম।